নিজস্ব প্রতিনিধি
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) পরিচ্ছন্নতা বিভাগের কর্মকর্তাদের ঘুষ দুর্নীতি আর অনিয়মের অপবাদ যেন থামছেই না। খোদ চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা কমান্ডার লতিফুল হক কাজমীর বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন সুজন চট্টগ্রাম’র এক সদস্য মো. আব্দুল বাতেন চৌধুরী । দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দেয়া অভিযোগে তিনি বলেছেন, নৌবাহিনী থেকে প্রেষণে আসা কর্পোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তার দায়িত্বে থেকে তিনি অপরিচ্ছন্ন যতোসব কাজে জড়িয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দায়ের করা অভিযোগ ও গোপন সংবাদদাতার মাধ্যমে হাতে আসা তথ্য উপাত্তে দেখা গেছে, বিতর্কিত এই কর্মকর্তা গত ১০ মাসে বিভিন্ন ইস্যু সৃষ্টি করে পরিচ্ছন্ন বিভাগ ও যান্ত্রিক শাখার টেন্ডার ও ইজিপির নামে সরকারি ক্রয়-বিধির (পিপিআর) ৭৬ (ট) ধারা ব্যবহার করে শতাধিক ফাইলে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে নয়ছয় করেছেন। যার মাধ্যমে ১০ কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছেন বলে দুদকে দায়ের করা অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন। এসব ফাইল এখন সিটি কর্পোরেশনের প্রধান হিসাব রক্ষন কর্মকর্তার দপ্তরে রক্ষিত আছে বলেও লিপিবদ্ধ করেছেন। এছাড়াও ২০২৩-২৪ পবি/সিক-ইষ্টি সিট নং- ১ থেকে ৭৮ নম্বর ফাইল পর্যন্ত মোট ৩৮ টি ফাইলে ভুয়া কাজ দেখিয়ে ২ কোটিরও বেশি টাকা আত্মসাত করার অভিযোগ তুলেন।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, তাঁর পরিচালনায় বেশ কয়েকটি বেনামী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেগুলো দিয়ে তিনি কর্পোরেশনের ঠিকাদারি কাজগুলো করে থাকেন। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ পাওয়া তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে, মেসার্স খাসবুন আল্লাহ, মেসার্স এন এস ইন্টারন্যাশনাল ও মেসার্স ফাতিহা ইন্জিনিয়ারিং উল্লেখযোগ্য। অভিযোগ রয়েছে, মেসার্স ফাতিহা ইন্জিনিয়ারিংয়ের প্রোপাইটর মাহমুদুর রহমান গাজী তাঁর আপন ছোট বোনের স্বামী। কাজ হাতিয়ে নেয়ার জন্য তিনি সিটি করপোরেশনে বিশাল একটি সিন্ডিকেটও গড়ে তোলেন।
অভিযোগকারীরা জানান, ভুয়া দরপত্র বিজ্ঞপ্তি তৈরি করে নিজের পরিচিত প্রতিষ্ঠানকে লাখ লাখ টাকার কাজ দিয়েছেন কমান্ডার কাজমী। যান্ত্রিক শাখার দায়িত্বে থেকে তিনি খাল-নালার মাটি ও আবর্জনা পরিষ্কারের নামে সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব স্কেভেটর, ড্রামট্রাকের মাধ্যমে কাজ করে জ্বালানি খরচের টাকা নিধারিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে বিল করে তা তাড়াহুড়ো হিসাব বিভাগ থেকে উত্তোলন করে নিতেন। কমান্ডার কাজমীর ছত্রছায়ায় থাকা কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কোন প্রতিষ্ঠান তেমন কোন উল্লেখযোগ্য কাজ পায়নি গত ১০ মাসে। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ৬ হাজার টাকার হুইল ব্যারো ১০ হাজার টাকা ক্রয় দেখিয়ে ১ হাজারটির জন্য ৫০ লাখ টাকা ঢালাও লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে। ৪০ টি নতুন বর্জ্যবাহী কন্টেইনার ক্রয়ে প্রতিটি সাড়ে তিন লাখ টাকার মধ্যে সাড়ে ৬ লাখ টাকা বিল করে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেবার অভিযোগ উঠেছে।
বাংলাদেশ নৌবাহিনী থেকে প্রেষণে আসা লতিফুল হক কাজমীকে ২০২৩ সালের ১২ অক্টোবর মাসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আবদুল্লাহ আরিফ মোহাম্মদ স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক গৃহীত (স্বারক: ২৩.০২.২৬২৬.১০১.১৩.০০৬.২৪.২৭৮৫) নথিপত্রে দেখা গেছে, আগামী ৩০ নভেম্বর এই প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা অবসরে যাচ্ছেন। দুর্নীতিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে আলোচিত হয়েছেন চাকরির এই ১০ মাসে। আওয়ামীলীগ সরকারের পছন্দের এই ব্যাক্তির ভয়ে সবাই নিরব থাকতেন। দাপটের সাথে রাতকে দিন আর দিনকে রাত বানাতেন কমান্ডার কাজমী। সাবেক মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরীর সাথে যোগসাজস করে এ কর্মকর্তা জনগণের করের টাকাসহ সরকারি অর্থের অপচয় ও আত্মসাৎ করার অভিযোগ সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর অনুসন্ধান জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হাতান কোটি টাকার কাজ
সরকারি ক্রয়-বিধি অনুযায়ী পাঁচ লাখ টাকার বেশি কেনাকাটা করতে হলে উন্মুক্ত দরপত্র আহবানন করতে হয়। কিন্তু পছন্দের ব্যক্তিকে কাজ পাইয়ে দিতে কেনাকাটা পাঁচ লাখ টাকার নিচে রাখতে হয়। অথচ সরকারি ক্রয়-বিধির (পিপিআর) ৭৬ (ট) অনুযায়ী কেনাকাটা শুধু অতি জরুরি বা প্রয়োজনীয় পণ্য, কার্য এবং সেবা ক্রয় করার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সিটি করপোরেশনের অসাধু কর্মকর্তারা ঠিকাদারদের কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা নিয়ে বারবার এই সুযোগ ব্যবহার করে আসছেন লতিফুল হক কাজমী।
আবর্জনার ট্রাক সর্বনিম্ন দরদাতাকে না দেয়া:
২০২৪ সালে পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে কোরবানির দিন ১১০ টি আবর্জনাবাহী ট্রাক টেন্ডারের মাধ্যমে সর্বনিম্ন দাতা প্রতিষ্ঠানের প্রোফাইটর মো. জসীম উদ্দিনকে সুকৌশলে বাদ দিয়ে আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয় বলে অভিযোগ করেছেন জসীম।
মশার ওষুধ ক্রয়ে সর্বনিম্ন দরদাতার নোহা ফেরত:
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনেরবিভিন্ন ওয়ার্ডে ছিটানোর জন্য মশার ওষুধ সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান ‘বেঙ্গলমার্ক’ কে ওয়ার্ক অর্ডার (নোহা) প্রদানের পরও ওষুধ সরবরাহ করতে না দিয়ে অপর একটি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয় বলে অভিযোগ করেছেন।
অনিয়মের ফাইলে স্বাক্ষর না করায় অব্যাহতি:
পরিচ্ছন্ন বিভাগের অনিয়মকৃত ৩৮ ফাইলে স্বাক্ষর না করায় কোনো কারণ দর্শানো নোটিশ ছাড়াই ৩০ সেপ্টেম্বর উপ-প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মোরশেদুল আলম চৌধুরীকে পরিচ্ছন্ন বিভাগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় অঞ্চল–১–এ সংযুক্ত করে ১ অক্টোবরের মধ্যে যোগদানের নির্দেশনা দেয়া হয় বলে অভিযোগ করেছেন উপ-প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মোরশেদুল আলম চৌধুরী।
তদন্ত প্রতিবেদন ছাড়াই অবমুক্ত প্রকৌশলী ঝুলন:
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবির প্রেক্ষিতে চসিকের বিদ্যুৎ উপ-বিভাগের তত্তাবধায়ক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তাঁর দূর্নীতির অভিযোগ তদন্তে দ্রুত রির্পোট করার জন্য গত ১৪ আগস্ট প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা কমান্ডার লতিফুল হক কাজমীকে আহŸায়ক করা হয়। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময়ে সড়কবাতি বন্ধের অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া ঝুলন কুমার দাশকে অজ্ঞাত কারণে তদন্ত প্রতিবেদন ছাড়াই গত ২৯ সেপ্টেম্বর অবমুক্ত করে অফিস আদেশ জারি করেন। চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা কমান্ডার লতিফুল হক কাজমীর নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি ১০ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা থাকলেও এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ‘সময়ক্ষেপণ’ করে রিপোর্ট দেয়া হয়নি বলে চসিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। প্রকৌশলী ঝুলনকে সাময়িক বরখাস্ত থেকে অবমুক্ত করতে লাখ লাখ টাকা বানিজ্য হয়েছে বলে একাধিক সুত্র নিশ্চিত করেছে।
নৌ বাহিনীর পোশাক পরে ব্যবসায়ীকে মারধর:
নগরীর আগ্রাবাদে অবস্থিত সিঙ্গাপুর ব্যাংকক মার্কেটের প্রচার সম্পাদক মনির হোসেন বাপ্পীকে গত ৬ এপ্রিল নৌ বাহিনীর পোশাক পরিহিত অবস্থায় মার্কেটের ভেতরে ব্যবসায়ীকে মারধর করেছেন কমান্ডার লতিফুল হক কাজমীর দলবল। মারধরের সেই দৃশ্য সমিতির সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়েছে।ভিডিওতে সিটি কর্পোরেশনের স্ট্রাইকিং ফোর্সের পোশাকধারীদেরও লাঠি দিয়ে ব্যবসায়ীকে মারধর করতে দেখা গেছে। সেই ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এ নিয়ে তখন নানা আলোচনা-সমালোচনা চলেছে। ব্যবসায়ীরা জানান, সিঙ্গাপুর ব্যাংকক মার্কেটের ৩৭১ নম্বর দোকানটির মালিক সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রকৌশলী আবদুল মালেক। তিনি প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা কমান্ডার লতিফুল হক কাজেমীর শ্বশুর।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে সিটি কর্পোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা কমান্ডার লতিফুল হক কাজেমী সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ‘এসব অভিযোগ কোনটিরই সত্যতা নেই। অহেতুক আমাকে হয়রানি করার জন্য কর্পোরেশনের একজন কর্মকর্তা এসব করছেন। আমি আমার সততা দিয়ে কর্পোরেশনের জন্যই কাজ করে আসছি। প্রতিটি কাজের আমি ডকুমেন্টারি রেখেছি। চাইলেই যেকোন সময় দেখানো যাবে। কেউ অভিযোগ করলেই আমি দুর্নীতি করে ফেলেছি, এমন তো না।’
ভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কাজ দেয়ার একমাত্র এখতিয়ার মেয়রের, আমার না। সুতরাং বিষয়টি মেয়রই ভালো বলতে পারবেন।’
অভিযোগের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-১ এর পরিচয় প্রকাশ করে কথা বলতে নারাজ এমন একজন কর্মকর্তা প্রাপ্তি স্বীকার করে বলেন, ‘একটি অভিযোগ আমরা পেয়েছি। অভিযোগ পেলেই প্রথমে আমরা তদন্ত করে দেখি এবং প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকি।’