গত ৫ই আগস্ট, ২০২৪ খ্রি. থেকে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব নিয়ে যা হচ্ছে তা অপ্রত্যাশিত ও দুঃখজনক। সঠিক পথে না গিয়ে একটি ঐক্যমত্য পৌঁছতে উভয় পক্ষ বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন বলে আমার ধারণা। উভয় পক্ষের মধ্যে কিছু লোক আছে যারা প্রেসক্লাবের দুটি কমিটি (২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নির্বাচিত কমিটি এবং স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর ২০২৪ সালের ৬ আগস্ট গঠিত অন্তর্বর্তী কমিটি) ও আন্দোলনকারীদের একসাথে বসে সমস্যা সমাধান করতে দিচ্ছে না, বরং উস্কানি দিচ্ছে সংঘাতের মধ্যে দূরত্ব আরও বাড়িয়ে দিতে। আর কিছু আছে যারা ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এ পরিস্থিতিতে চুপ রয়েছে।
এ ধরণের লোকদের সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘যারা কোন সংকটে সঠিক ও সত্য কথা বলে ভূমিকা না রেখে চুপ করে থাকাকে বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক মনে করে তারা বোবা শয়তান’। চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের অন্তর্বর্তী কমিটি গঠনের বিষয়টি মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা অবহিত আছেন বলে জানা যায়। আমি আগেও বলেছি, সাংবাদিকতা একটি মহৎ পেশা, সৎ পেশা। যারা এ পেশায় সততার সাথে লেগে আছেন তারা সাধু, তারা আল্লাহর প্রিয় বান্দা। সৎ সাংবাদিকদের উপর যারা বিভিন্নভাবে জুলুম করে তাদেরকে কেউ কোন ধরণের শাস্তি দিতে না পারলেও এই জালেমদেরকে আল্লাহ কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তি দেবেন। সাবধান হয়ে যান, আল্লাহর প্রিয় বান্দা সৎ সাংবাদিকদের উপর জুলুম করবেন না কেউ।
অনেকে আছে, দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যক্তিগত আক্রোশ চরিতার্থ করতে চাচ্ছে। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কারো কারো মধ্যে ঈর্ষা, হিংসা, প্রতিযোগিতা বা অন্য কোন কারণে আক্রোশ হয়ে থাকতে পারে। এই ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক আক্রোশকে প্রেসক্লাব ইস্যুতে টেনে আনবেন না। নীতিগতভাবে অবশ্যই স্ব স্ব অবস্থান থেকে মাথা উচু করে থাকতে পারবেন। তবে স্বৈরাচারের দালাল সাংবাদিক-সম্পাদকদের দ্বারা নিপীড়নের কথা স্মরণ রাখবেন- শুধু মাত্র শিক্ষা নেওয়ার জন্য।
ঝুঁকি নিয়েই শুরু সাংবাদিকতা পেশা। হুমকি-ধমকি, অপশক্তির রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করেই সাংবাদিকরা ব্রতী হন সত্যানুসন্ধানে। সীমাহীন প্রতিকূলতার মাঝেও পেশাগত সততা ও মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতেন সাংবাদিকরা। মৃত্যু গহ্বরে দাঁড়িয়ে ঘটনার প্রত্যক্ষ তথ্য সংগ্রহ করেন সাংবাদিকরা। তাই এ পেশা মৃত্যুঞ্জয়ী। আঘাত আর প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেই এ পেশায় সামনে যেতে হয়। কিন্তু এ আঘাত আর প্রতিবন্ধকতা যদি আসে রাষ্ট্রশক্তির কাছ থেকে তখনই সাংবাদিকরা হয়ে পড়েন বিধ্বস্ত-বিপর্যস্ত। সাংবাদিকতা পেশা হয়ে পড়ে বিপন্ন। সত্যভীতু সরকার-প্রশাসন সৎ ও নির্ভীক সাংবাদিকদের প্রতি প্রতিহিংসা আর রোষের অনলে জ্বলছিল বিভিন্ন কারণে। ফ্যাসিবাদী সরকার চেয়েছিল বশংবদ সাংবাদিক। মানবিক গুণাবলিহীন দাস সাংবাদিক। বিভিন্ন সময়ে সরকার, প্রশাসন ও কর্তৃত্ববাদী গোষ্ঠী উন্নতশির সাংবাদিকদের নিঃশেষ করতে চেয়েছে। এস্টাবিলিস্টমেন্ট (ঊংঃধনষরংযসবহঃ) বরাবরই ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাহীন, সমালোচনায় অসহিষ্ণু, ক্ষমতার একচ্ছত্র আধিপত্যে বিশ্বাসী।
আমাদের সাংবাদিকদের মধ্যে অনেকেই আছেন বিত্ত-বৈভবের কারণে তাদের মধ্যে আত্মম্ভরিতা ও বিলাসিতা বিস্তার লাভ করেছে। তারা কারো মতামত, পরামর্শ নিতে চান না- তাদের অযৌক্তিক, বেআইনী মতামতকে অন্যদের উপর চাপিয়ে দিতে চান। তারা বুঝতে চান না যে, আত্মম্ভরিতার কারণে সরকার প্রধানকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। অনেক জান-মালের ক্ষতি হয়েছে- আর নয়, এবার ক্ষান্ত হন।
একটি বিষয়ে আমাদের সাংবাদিক সমাজের জন্য বলতে চাই, তা হল: সাংবাদিক হিসেবে আইন সম্পর্কে আমাদের অধ্যায়ন, ধ্যান ও অনুধ্যান খুবই জরুরী। এতে আমাদের নিজেদের অধিকার প্রয়োগের সাথে সাথে অন্যের অধিকার যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এই বিষয়ে সম্যক জ্ঞান ও ধারণা থাকবে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস থাকতে হবে, নিজের স্বাধীনতার অধিকারের সাথে অন্যের স্বাধীনতার অধিকারও একই নীতিতে অবিচলিত, সামঞ্জস্যপূর্ণ।
গত কয়েকদিন থেকে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের কয়েকজন স্থায়ী সদস্য প্রবীণ সাংবাদিক বন্ধু বলে আসছেন প্রেসক্লাব খুলে দেবার বিষয়ে মত দিতে। আমি বরাবরই প্রেসক্লাব খুলে রাখা চাই। আমি সর্বশেষ ব্যক্তি ৫ই আগস্ট প্রেসক্লাবের এবাদতখানায় আছরের নামাজ পড়ে বের হয়েছিলাম। দুপুরে জোহরের নামাজের পর বাসায় চলে আসতে চেয়েছিলাম। হাউজিং সোসাইটির সাবেক চেয়ারম্যান প্রিয় স্বপন মল্লিক তখন বললেন, সেনাবাহিনী প্রধান বেলা ২ টায় ভাষণ দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছে তা শুনে যান। ২ টায় যখন ঘোষণা করল সেনাবাহিনী প্রধান ২ টার পরিবর্তে ৩ টায় ভাষণ দেবেন। এরপর কি ঘটেছে সকলেই টেলিভিশনের মাধ্যমে দেখেছেন। বিকেলে চলে আসার আগে আমি যখন এবাদতখানায় আছরের নামাজরত তখন প্রেসক্লাবের কর্মচারীরা তাড়াহুড়া করে সব লাইট বন্ধ করে দিচ্ছে। সালাম ফিরিয়ে যখন প্রেসক্লাবের কর্মচারী জহির এবং উপস্থিত অন্যান্য কর্মচারীদের জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন ‘স্যার প্রেসক্লাবে হামলা হয়েছে। আপনি তাড়াতাড়ি চলে যান। সবাই চলে গেছেন’। আমি ৫ তলার এবাদতখানা থেকে নামতে দেখি সবলাইট বন্ধ। সিঁড়ি অন্ধকার। জহির আমাকে ধরে ধরে নীচে নামিয়ে আনলে দেখি স্নেহভাজন সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম শিল্পী গেইটে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে? সে বলল হামলার আশঙ্কায় প্রেসক্লাব পাহারা দিচ্ছি। আমি গেইট দিয়ে বাইরে এসে শিল্পীকে বললাম ভালভাবে পাহাড়া দাও যাতে প্রেসক্লাবের কেউ ক্ষতি করতে না পারে। সে বলল ঠিক আছে। এরপর কয়েকদিন তো অনেক ঘটনা হয়ে গেল। সেনাবাহিনী এসে চাবি নিয়ে গেল এবং পরে কমিটি চাবি নিয়ে আনল। আবারো ঘটনা ঘটল, আবারো চাবি নিয়ে গেল। কেউ বলছেন সেনাবাহিনী কেউ বা বলছেন ছাত্ররা নেতারা চাবি নিয়ে গেছেন। এরপর থেকে প্রেসক্লাব বন্ধ রয়েছে। আসলে প্রেসক্লাবের চাবি কার কাছে? জনশ্রুতি আছে যে, ক্লাবের চাবি ক্লাবের পূর্বতন কমিটির কাছে রয়েছে। যার কাছেই হউক প্রেসক্লাব খুলে দিয়ে স্বস্থির পরিবেশ ফিরিয়ে আনুন। আল্লাহর ওয়াস্তে সাংবাদিকদের, সদস্যদের আর কষ্ট দিয়েন না। যে সকল প্রবীণ সদস্য আমার সাথে যোগাযোগ করেছেন, কথা বলেছেন কথায় স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে তাদের অন্তর আত্মার অভিশাপ দিয়েছে। এই নীরহ, প্রবীণ, অসহায় সাংবাদিকদের অভিশাপ থেকে সকলকে বাঁচতে হবে।
সকল সমস্যা একদিনে বা একরাতে সমাধান করা সম্ভব নয়। আসুন, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সকল সদস্য ও অসদস্য, চট্টগ্রামের সকল সাংবাদিক ঐক্যবদ্ধ হই। সমাধানের সঠিক পথ বের করি। আল্লাহ সকলকে সঠিক বুঝ দান করুন।
প্রতিটি সদস্যের দায়িত্ব রয়েছে প্রেসক্লাবকে রক্ষা করা। প্রেসক্লাবকে রক্ষার দায়িত্ব থেকে প্রবীণরা পিছু হঠতে পারব না। একি সাথে যে সকল কর্মকর্তা ও সদস্যের বিরুদ্ধে নিপীড়ন ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পরিবেশ, পরিস্থিতি ও ঘটনা প্রবাহের কারণে বিবেকের তাড়নায় বলতে হচ্ছে, এখন সংবাদ ও গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকদের বিশাল অংশ বোল পাল্টাতে, রঙ বদলাতে শুরু করেছে। ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া পর্যন্ত হাসিনার শাসনের পক্ষে ছিল; ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উম্মা প্রকাশ করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হবার পরামর্শ দিয়েছে। আমাদের চট্টগ্রামেও অনেক সাংবাদিক ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে তা করেছে। আবার অনেকের কাছে এটাস স্ক্রীনশর্টও আছে। পুলিশ বাহিনীকে দানবে পরিণত করতে উদ্বুদ্ধ করেছে সে ধরণের সম্পাদক-সাংবাদিকরা এখন বোল পাল্টাচ্ছে, রঙ বদালাচ্ছে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ‘ড. মুহাম্মদ ইউনুস’ এর উপর নিপীড়ন না করার আহ্বান জানিয়ে নোবেল বিজয়ী শতাধিক বিশ্ববরণ্য ব্যক্তি শেখ হাসিনার কাছে খোলা চিঠি দিয়েছিল এবং এই খোলাচিঠিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ দাবি করে ৫০ জন সম্পাদক প্রতিবাদী বিবৃতি দিয়ে গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করেছিল, সেই সম্পাদকরা এখন রঙ বদল করে, বোল পাল্টিয়ে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার কাছে আমরা আপনার লোক প্রমাণে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ড. ইউনুসের উপর বিগত হাসিনা সরকার কি নির্যাতনই না করেছে! আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের রয়েছে। এটা সাংবিধানিক অধিকার। এই অধিকার থেকে ড. ইউনুসকে বঞ্চিত করা হয়। তিনি হাইকোর্টে রীট করতে গিয়েছিলেন। শুনানীর আগে তার রীট খারিজ করে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়- অন্যায়ভাবে। অথচ সংবিধানের অনুচ্ছেদ: ৩১ অনুসারে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার অনুচ্ছেদ: ৪৪ অনুযায়ী মামলা রুজু করার অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া থাকলেও ড. ইউনুস কি সেই সাংবিধানিক অধিকার পেয়েছিলেন? সংবিধানের অনুচ্ছেদ: ৯৪ (৪) অনুযায়ী বিচার কার্য পরিচালনায় বিচারকগণ স্বাধীন বলা হলেও আসলে কি শেখ হাসিনার শাসনামলে বিচারকগণ স্বাধীন ছিলেন? আমাদের দেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ: ২৫ (গ) অনুসারে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের সংগ্রামকে বাংলাদেশ সমর্থন করার কথা সন্নিবেশিত। আমাদের দেশের কোন নাগরিক ও বিশ্ববরেণ্য কোন ব্যক্তি যদি নিপীড়নের শিকার হন এবং সে কারণে বিশ্বের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও নোবেল বিজয়ীরা কিছু বললে বা বিবৃতি দিলে তাতে নিজেরা সংশোধন না হয়ে উল্টো প্রতিবাদ দিয়ে, শেখ হাসিনা সরকারের উৎপীড়নের পক্ষে অবস্থান নিয়ে ড. ইউনুসের উপর জুলুম করাকে সমর্থন করা কি সম্পাদকদের জন্য শোভনীয় ছিল? ঢাকায় ২৯ জন সাংবাদিক এবং চট্টগ্রামে ২৮ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ছাত্র-জনতা হত্যার উস্কানি দানের অভিযোগ এই মামলা হয়েছে বলে জানা যায়। মামলা দায়ের করার কারণে কোন কোন সংগঠন নিন্দা জানিয়েছে, উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আমি আশা করব, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের উপর অযৌক্তিক খারাপ কিছু করবে না।
অতপরঃ বলতে হয়, ২০১৮ সালের ২৩ শে জুলাই কুষ্টিয়ার আদালত প্রাঙ্গণে আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে রক্তাক্ত করার পর কোন সম্পাদক ও সাংবাদিক সংগঠনের পক্ষ থেকে উদ্বেগ বা নিন্দা করা হয়নি। ২০১৮ সালের ৪ ঠা নভেম্বর রংপুর আদালত চত্বরে দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদকমন্ডলীর সাবেক সভাপতি ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে গ্রেফতার অবস্থায় নাজেহাল করলেও আমাদের সম্পাদক-সাংবাদিক ও সংগঠন কর্মকর্তাদের বিবেক নাড়া দেয়নি। তখন তারা শেখ হাসিনার তোষামেদ ও বন্দনায় প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত ছিল- সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে ২০১৮ সালের শেষ দিকে গ্রেফতার করে হয়রান ও নির্যাতন করেছিল শেখ হাসিনা সরকার। তখন তার মুক্তির দাবি করে বিবৃতি দেবার জন্য প্রেসক্লাব, সাংবাদিক ইউনিয়ন, সম্পাদকদের কোন সংগঠনকে পাওয়া যায়নি। সিএমইউ জের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক, বর্তমান সভাপতি স্নেহভাজন মোহাম্মদ শাহনওয়াজ এর সাথে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে এ বিষয়ে কথা বলে একমত হলেও সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতার কারণে তারা বিবৃতি দিতে পারেননি। আমি যেহেতু বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল, প্রেস কাউন্সিল জুডিসিয়াল কমিটিতে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের সাথে সদস্য ছিলাম, বিএসপিতে তিনি সভাপতি এবং আমি সহ-সভাপতি ছিলাম। ঐ ভীতিকর অবস্থায়ও আমি মনে করেছি, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের মুক্তি দাবি করা আমার নৈতিক দায়িত্ব। তখন আমি একটি বিবৃতি দিয়েছিলাম। এটি দৈনিক ইনকিলাব, দৈনিক নয়াদিগন্ত, নিউনেশন এবং চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত হয়েছিল। পেপার কাটিং কমেন্ট বাক্সে সংযুক্ত আছে। ঐ বিবৃতি প্রকাশের পর আমার উপর অনেক ঝড় বয়ে গেছে। কাউকে কিছু বলিনি। শুধু এজেন্সীর লোক জিজ্ঞেস করলে বলেছি ‘প্রধানমন্ত্রীকে আমার বিবৃতির বিষয়বস্তুটা জানান। উনি বললে কিছু করেন’। কয়েকজন অনুজ প্রতীম, অনুবর্তী সহকর্মী সাংবাদিক ভাই আমাকে ভয় দেখাতে চাচ্ছিল। আমি বললাম, মৃত্যুত একদিন হবেই। আমি মজলুমের পক্ষে ছিলাম, আছি, ইনশাল্লাহ থাকব। গত ২৪ শে ডিসেম্বর ২০২৩ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আমাকে বক্তব্য দিতে আমন্ত্রণ জানালে বক্তৃতায় আমি ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের উপর নির্যাতনের বিষয়টি উল্লেখ করলে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের একজন সাবেক সভাপতি রাগ ও ঘৃণা উদ্রেগকারী অশোভন মন্তব্য করলেন। অথচ সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী (হীরু) পরিশীলিত, সুন্দর ও শোভনীয় মন্তব্য করলেন ব্যারিস্টার মইনুল সম্পর্কে। ঐ অনুষ্ঠানে আজাদী সম্পাদক শ্রদ্ধেয় মালেক মামা উপস্থিত ছিলেন এবং সভাপতিত্ব করেন ইত্তেফাকের ব্যুরো প্রধান চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব সভাপতি সালাহউদ্দিন রেজা। আমাদের মধ্যে দালাল, স্বার্থান্বেষী, ক্ষমতার উচ্ছিষ্টভোগী সম্পাদক-সাংবাদিকের অভাব নেই। এদের তোষামেদীর কারণেই গণমাধ্যম ও পবিত্র সাংবাদিকতা পেশা কলুষিত হয়েছে।
তোষামেদকারী এই সাংবাদিকরা ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪ সালের পাতানো নির্বাচনের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে জনগণের ভোটাধিকার হরণ ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা বিরোধী কালাকানুন করতে শেখ হাসিনাকে সহায়তা করেছেন। বিনিময়ে তারা কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। কেউ প্লট, ফ্ল্যাট নিয়েছেন, কেউ তদবির বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। কেউ আবার বিভিন্ন কর্পোরেশন, সেক্টর, ব্যাংক বীমার মালিক হয়েছেন, কেউ কেউ দূতাবাস, সরকারী প্রতিষ্ঠানের পদ-পদবী এবং বিশ্ব বিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে অর্থ সম্পদ লুট করেছেন। দেশের বিপুল সংখ্যক সাংবাদিক এখনো অর্থ সংকটে স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে না। অথচ নীতিহীন, আদর্শহীন, স্বার্থান্বেষী সাংবাদিকরা শেখ হাসিনার ১৫ বছরে কেউ দশ, বিশ বা শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। শেখ হাসিনা সরকারকে টিকিয়ে রাখতে দেশের বেশিরভাগ পত্রপত্রিকা ও মিডিয়া এবং তাতে কর্মরত একশ্রেণীর সাংবাদিক বছরের পর বছর তার তোষামোদি করে গেছে। তারা হাসিনার অন্যায় ও নিষ্ঠুরতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়তা করেছে। সাংবাদিকতার নীতি-আদর্শের ধারেকাছে ছিল না। তাদের কর্মকা- ছিল দলীয় নেতাকর্মীর মতো। অনেকে আওয়ামী লীগের পদে থেকে সাংবাদিকতাও করছে। তাদের মধ্যে এ প্রতিযোগিতা ছিল, হাসিনার দালালিতে কে, কার চেয়ে বেশি এগিয়ে থাকতে পারে এবং হাসিনার বিদেশ সফরে কে কার আগে যাবে। তারা সাংবাদিকতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে হাসিনার কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছে। তাদের সম্পদ ও বিলাসী জীবন দেখে যে কারো চোখ কপালে উঠে যায়। হাসিনার দালাল সাংবাদিকের তালিকা এখন বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। তারা প্রথম শ্রেণির দালাল। এদের পেছনে আবার আরেক দল রয়েছে, যারা দালালি করে সাংবাদিকতা কি, তাই ভুলিয়ে দিয়েছে। এরা যেন সাংবাদিকতা করতে আসেনি, এসেছে স্বৈচারাচারের দালালি করতে। সাংবাদিকতার ন্যূনতম এথিকস তারা মানেনি। দলীয় কর্মীর মতো শেখ হাসিনার পদলেহন করেছে। এমনকি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ও এসব সাংবাদিক প্রেস ক্লাবের সামনে বিরোধিতা করে জ্বালাময়ী বক্তৃতা করেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর এসব দালাল সাংবাদিককে এখন প্রেস ক্লাবে কম দেখা যায়। তারা অনেকে গা ঢাকা দিয়ে আছে।
এই দালাল সাংবাদিকরা দেশের সাংবাদিকতাকে কলুষিত করেছে এবং তারা বহালতবিয়তে থাকলে যে, তা কলুষমুক্ত হবে না, তা নিশ্চিত। শেখ হাসিনার দালালী করে রাঘব-বোয়াল হয়ে উঠা সাংবাদিকদের অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। তারা যদি সত্যিকারের সাংবাদিকতা করত, তাহলে তারা পালাবে কেন?
পবিত্র পেশা সাংবাদিকতাকে কলুষমুক্ত করতে চাইলে এই নীতিজ্ঞানশূন্য, ভ্রষ্ট, লোভী সম্পাদক-সাংবাদিকদের সর্বত্র বর্জনের ডাক দিয়ে সৎ সাংবাদিক-সম্পাদকদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।