নিজস্ব প্রতিনিধি
আনোয়ারা থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি কাজী মোজাম্মেল হক রাজনীতিতে নিরব ছিলেন গোটা কয়েক বছর। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ থেকে যোজন যোজন দূরত্ব হয় ছাত্রলীগ থেকে গড়ে উঠা মেধাবী ও দক্ষ সংগঠক কাজী মোজাম্মেল হকের। আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি হওয়া সত্বেও সর্বশেষ থানা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে কাজী মোজাম্মেল হক উপস্থিত ছিলেন না। এই সম্মেলনে দাওয়াত পাননি আওয়ামী লীগের অর্থ পরিকল্পনা সম্পাদক ওয়াসিকা আয়শা খান এমপি, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সাবেক আনোয়ারা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল কালাম চৌধুরী ও কাজী মোজাম্মেল হকসহ অনেক সিনিয়র নেতারাও। জাবেদ অনুসারী হলেও তৎসময়ের উপজেলা চেয়ারম্যান তৌহিদুল চৌধুরীও মঞ্চে অবহেলিত হন। অপমানিত হন অনেক ত্যাগী ও লীগ প্রেমিক অসংখ্য নেতাকর্মীও। ইদ্রিস বিকমের নাম উল্লেখ করেননি অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদও। এসবের পেছনে একচেটিয়া অভিযোগ উঠে রিদুয়ানুল হক সায়েমের বিরুদ্ধে। সায়েম সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের এপিএস ও ঘনিষ্টজন হিসেবে সমধিক পরিচিত।
৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সরকার গঠন হলে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের মন্ত্রী পরিষদে ঠাঁই হয়নি। তার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীকে না জানিয়ে পিটার হাসের সাথে দেখা করা, আওয়ামী লীগ সরকারকে পুলিশ বান্ধব সরকার বলা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া বিদেশে টাকা পাচারসহ নানা গুরুতর অভিযোগ উঠে দলে ও সরকারে।
এরই মধ্যে ১লা মার্চ ২য় দফায় মন্ত্রী পরিষদে অর্থ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ প্রয়াত আতাউর রহমানের খান কায়সারের বড় মেয়ে ওয়াসিকা আয়শা খান শপথ নেন। তখন আনোয়ারাতে রাজনৈতিক মেরুকরণ শুরু হয়। কর্ণফুলী ও আনোয়ারায় ওয়াসিকা সংবর্ধনা সভায় সাধারণ মানুষের ঢল নামে। ওয়াসিকা সমর্থিত পুরানোদের সাথে অবহেলিত ও ত্যাগী নেতাকর্মীরা ওয়াসিকাকে সমর্থন দেয় এবং জাবেদের নানান ফিরিস্তি তুলে ধরে মাঠে- ঘাটে সমালোচনা শুরু করে।
মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে ওয়াসিকা চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতাদের কবর জেয়ারত ও শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়ে নিজের বিবেকের অবস্থান জানান দেন। তিনি এম.এ. আজিজ, ইসহাক মিয়া, এম এ হান্নান, জহুর আহমদ চৌধুরী ও এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কবরে ফুল দেন, জেয়ারত ও শ্রদ্ধা জানান। এরপর তিনি আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ও ইদ্রিচ বিকম এর কবর জেয়ারত ও ফুলেল শ্রদ্ধা জানান। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ও ইদ্রিস বিকমের কবর জেয়ারত আনোয়ারা ও চট্টগ্রামের মানুষেরা পজিটিভ দৃষ্টিতে দেখেন ও তখন থেকেই ওয়াসিকার প্রশংসা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এরমধ্যে জাবেদ আনোয়ারার এক সভায় বললেন- আনোয়ারায় দ্বৈত শাসন চলবে না। মিটিং করতে হলে ১ সপ্তাহ আগে অনুমতি নিতে হবে। এই বক্তব্যে তোলপাড় শুরু হয় গোটা চট্টগ্রাম জুড়ে। ওয়াসিকা উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ পরিদর্শন ও পরে সভা, কিছুদিন পর চাতরীতে বিশাল জনসভা এরপর উপকূলীয় রায়পুর হাইস্কুল মাঠে বিশাল জনসভা হবার পর জাবেদের বক্তব্যের সারাংশ বুঝে নেন সাধারণ জনগণ। তখন থেকে ওয়াসিকার জনপ্রিয়তা হু-হু করে বাড়তে থাকে।
আনোয়ারা সদর, পারর্কী বীচ, চাতরী চৌমুহনী ও রায়পুরের জনসভায় অন্যন্যদের মধ্যে কাজী মোজাম্মেল হকের বক্তব্য ব্যাপক সাড়া মেলে। ওয়াসিকাও বুঝে নেন কাজী মোজাম্মেল হকের প্রতি মানুষের ভালবাসা ও আস্থার ভিত্তি।
দূরদর্শী ও দক্ষ রাজনীতিবীদ ওয়াসিকা আয়শা খান উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে কাজী মোজাম্মেল হককে সমর্থন দেন। অন্যদিকে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যাপক এম.এ. মান্নানকে সমর্থন দেন। কিন্তু জাবেদ সমর্থিত উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী তৎকালিন চেয়ারম্যান তৌহিদুল হক চৌধুরীও প্রার্থী হন। জাবেদের পক্ষে দুইজন ওয়াসিকার পক্ষে কাজী মোজাম্মেল হক নির্বাচনী মাঠ চষে বেড়ান। নির্বাচনী প্রচার চলাকালে জাবেদ তার বাসায় ডেকে নিয়ে দুই প্রার্থীকে এক করে দিয়ে অধ্যাপক এম.এ. মান্নানকে সরে দাঁড়াতে নির্দেশ দেন। এম.এ মান্নানও তার নেতার নির্দেশে সরে দাঁড়ান। তখন থেকে ওয়াসিকা ও জাবেদের প্রার্থীতা স্পষ্ঠ হয়। এই সময় ভোটারেরা ওয়াসিকা বনাম জাবেদ দুই শিবিরে বিভক্ত হয়। প্রচারণাও চলে সর্বশক্তি বিনিয়োগ করে।
অবশেষে ২৯ মে নির্বাচনী ফলাফলে ওয়াসিকা সমর্থিত প্রার্থী কাজী মোজাম্মেল হক বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়। বিজয়ের উৎসব চলাকালে মান্নানের দায়ের করা মামলায় কর্ণফুলী থানা পুলিশ ও আনোয়ারা পুলিশ যৌথ উদ্যোগে আসামী ধরতে রাতে আঁধারে চাতুরীতে হানা দেয়। এবার যেন ওয়াসিকা সমর্থকদের সাথে পুলিশ যুদ্ধ হয়। আহত হয় পুলিশ ও মোজাম্মেল সমর্থিত সাধারণ ভোটারেরা। পুলিশ ছিনিয়ে নিতে পারেনি জনগণের নেতা জনগণের কাজ থেকে। পুলিশ সুযোগ পায় আরেকটি মামলা করার। ওই মামলায় আসামী করা ৪৪ জন মোজাম্মেল সমর্থকদের। শপথের আগে ষড়যন্ত্রমূলক দু’টো মামলার জড়িত হয় ওয়াসিকা সমর্থিত কাজী মোজাম্মেল হকের সমর্থকেরা। এই ষড়যন্ত্রের সুত্র ধরে দায়িত্ব হস্তান্তরের অনুষ্ঠানের দিনেও ৯ জন চেয়ারম্যান নিরাপত্তার অভিযোগ তুলে উপজেলা পরিষদের সভায় অনুপস্থিত থাকেন। ফলে সভাটি স্থগিত হয়। কেউ কেউ বলতে শুনা গেছে, ষড়যন্ত্র করে অনুপস্থিত থাকলেও আরেকটি মামলা থেকে বাঁচল হয়ত মোজাম্মেল সমর্থকেরা। দায়িত্ব হস্তান্তর অনুষ্ঠানে বিপুল সংখ্যক ওয়াসিকা সমর্থকেরা উপজেলা চত্বরে উৎসবে যোগ দেন। এই সময় নিজ সমর্থিত লোকজনের মধ্যেও ভীড় লেগে যায়। চেয়ারম্যানগণ উপস্থিত হলে এই ভীড়ের মধ্যে ধাক্কা ধাক্কি মনে করলে ঘটত আরেকটা বিপর্যয়। অভিজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষরা বলেছেন চেয়ারম্যানগণের দাবিও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এইবার নিরাপত্তা অভিযোগ তুলেছেন কিন্তু পরের বার চেয়ারম্যানগণ কি অভিযোগ তুলবেন?
সব মিলিয়ে সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে বিপুল ভোটে কাজী মোজাম্মেল হক নির্বাচিত হলেন, শপথও নিলেন, দাযিত্বও বুঝে পেলেন এখন সেবা দেবার পালা। এখানে বাঁধা আসলে আনোয়ারাবাসী দেখবে ও বুঝবে এবং সঠিক সিদ্ধান্তও নেবে। সময়ই নির্ধারণ করবে নেতৃত্ব দেবার যোগ্য কে বা কারা?