মুহাম্মদ মনছুর
জন্মসূত্রেই মানুষ কৌতুহলি প্রাণি। তাই অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনার আগ্রহ মানুষের চিরকালের। মুক্ত বিহঙ্গের মতো সে ছুটে যেতে চায় সংসারের সংকীর্ণ সীমানা ছাড়িয়ে দূরে কোথাও। যেখানে নেই এক ঘেঁয়েমি, ক্লান্ত, দুঃখ-ব্যথা। দীর্ঘকাল ধরে এই ইচ্ছেই মানুষকে নিয়ে গেছে পৃথিবীর নানা দেশে, পাহাড়-পর্বতে, সমুদ্রে, প্রকৃতির সৌন্দর্যের মাঝে। পরিচিতি গন্ডির বাইরে তার মন ভিড় করে সৌন্দর্য, বৈচিত্র্য ও দূর অজানার নানা আকর্ষণ, যেখানে গেলে প্রসারিত পৃথিবী, নৈসর্গিক শোভা, মানুষের বৈচিত্র্ময় জীবন যাপন দেখে ভিন্নতার স্বাদ পাবে। পাবে আনন্দ। সজীব হবে শুষ্ক মন। চিত্তের ঘটবে মুক্তি। সংসারের সীমাবদ্ধতা জীবন আর দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততার কারনে অনেক সময় মানুষের প্রয়োজন শুশ্রুষা। তাছাড়া একটা নির্দিষ্ট স্থানে দীর্ঘকাল আবদ্ধ থাকলে মানুষের হৃদয় ও মন সংকুচিত হয়ে যায়। চিত্তের স্বাভাবিক প্রসারতা ব্যাহত হয়। ভ্রমণের আনন্দে মানুষের এসব সংকীর্ণতা থেকে মুক্তি ঘটায় চিত্তের।
বিশ্বকবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই লিখেছেন-
“বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি
দেশে দেশে কত না সাগর রাজধানী
মানুষের কত কীর্তি, কত নদি গিরি সিন্দু মরু
কত না অজানা জীব, কত না অপরিচিত তরু
রয়ে গেল অগোছরে”।
ভ্রমণ কেবল আনন্দের উৎসই নয়, শিক্ষা লাভেরও অন্যতম উপায়। শিক্ষার অন্যতম অঙ্গ হল দেশ ভ্রমণ। ক্ষুদ্রের সঙ্গে বৃহত্তের যোগাযোগ ঘটায় বলে ভ্রমণ শুধু নিছক আনন্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনা। ভ্রমণের মাধ্যমেই মানুষ পায় বিচিত্র মানুষের সান্নিধ্য, প্রকৃতির প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ, অপার আনন্দ এবং লাভ করে প্রকৃত শিক্ষা। প্রকৃতির রাজ্যে আমরা এক ক্ষুদ্র জীব মাত্র। এ পৃথিবী বিশাল এবং বিচিত্র তার সৌন্দর্য। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে নানা রকম জীব জন্তু, গাছপালা আর মনোরম নৈসর্গিক দৃশ্য। বৃহত্তর জীবন। সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয়ের ফলে মুছে যায় মনের সব ক্ষুদ্রতা আর তুচ্চতা। ভ্রমণে মনের জীর্ন -শীর্নতা ও বন্ধ দরজাগুলো দিয়ে চেতনার নতুন আলো ছড়ায় প্রাণে।
তাছাড়া ভ্রমণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের Harvard School of Public Health এর প্রখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী ড. আই মিনলী ২০ বছর ব্যাপি ১,৭৩,০০০ জন মধ্য বয়সি পুরুষ ব্যক্তির উপর তাদের হাঁটার গতিবেগ, প্রতিক্রিয়া, স্বাস্থ্যের অবস্থা, খাদ্যরুচি, জীবনকাল ইত্যাদির উপর ব্যাপক গভেষণা চালিয়েছেন। ফলে তার প্রাপ্ত একটি তথ্য হল, যারা প্রায় প্রত্যেকদিন দ্রুতবেগে হাঁটেন তারা দীর্ঘজীবি হন। তাদের থেকে বেশি দীর্ঘজীবি হন যারা সপ্তাহে একদিন দুইদিন ভ্রমণ বা দৈহিক ব্যায়ামে ঘর্মাক্ত হন। আনন্দের উৎস হিসেবে এই। সেই সঙ্গে শিক্ষার অঙ্গ হিসেবে ভ্রমণের গুরুত্ব অপরিসীম। জাতি সংঘ ভ্রমণ কে বিশ্ব শান্তির ছাড়পত্র বলে অভিহিত করেছেন। ভ্রমণ যা আমাদের মনকে মুক্ত করবে সব ক্লান্তি, জটিলতা, উদ্বিগ্নতা থেকে। ভ্রমণের তীব্র বাসনাই প্রকাশ পেয়েছে জাতীয় কবি কাজি নজরুল ইসলামের “সংকল্প” কবিতায়-
“থাকব না ক বদ্ধ ঘরে
দেখব এবার জগৎটাকে
কেমন করে ঘুরছে মানুষ
যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে”
ভ্রমণের মাধ্যমে মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ় হয়।