জ্বালানি কাঠ, টায়ার ও গার্মেন্টের ঝুট কাপড় জ্বালিয়ে ইট পুড়িয়ে থাকে ওরা
নিজস্ব প্রতিনিধি
অল্প খরচে অধিক মুনাফা এবং কাঁচামালের সহজলভ্যতায় চট্টগ্রামে যত্রতত্র গড়ে উঠছে ইটভাটা। এতে পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি কৃষিক্ষেত্রে পড়ছে প্রভাব। রাজনৈতিক ছত্রছায়া নিষিদ্ধ ইটভাটা চালুর প্রস্তুতি চলছে ঘাটে ঘাটে ম্যানেজের গুন্জনও শুনা যাচ্ছে।
প্রশাসনের নামমাত্র অভিযান ইটভাটার সাময়িক উৎপাদন থামাতে পারলেও মিলছে না দীর্ঘমেয়াদী সুফল। পরিবেশ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, চট্টগ্রামের ১৪ উপজেলায় মোট ইটভাটার সংখ্যা ৩২০টি।
এর মধ্যে ১৩৮টি ইটভাটার বৈধ কাগজপত্র থাকলেও বাকি ১৮২টিরই নেই অনুমোদন। ১৪ উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬৮টি ইটভাটা সাতকানিয়া উপজেলায়।
এছাড়া রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় ৫০টি, ফটিকছড়ি উপজেলায় ৩৩টি, লোহাগাড়া উপজেলায় ৩৩টি, রাউজান উপজেলায় ৩২টি, হাটহাজারী উপজেলায় ৩১টি, চন্দনাইশে ২৮টি, মিরসরাইয়ে ১৩টি, কর্ণফুলী এলাকায় ১০টি, সন্দ্বীপে ৬টি, বাঁশখালীতে ৫টি, সীতাকুণ্ডে ৪টি, বোয়ালখালীতে ৪টি, আনোয়ারায় ২টি ও পটিয়ায় ইটভাটা রয়েছে ১টি ।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ এর ৫ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনও ব্যক্তি ইট প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে কৃষিজমি বা পাহাড় বা টিলা হতে মাটি কেটে বা সংগ্রহ করে ইটের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। এছাড়া ৬ ধারায় বলা হয়েছে, কোনও ব্যক্তি ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে জ্বালানি হিসেবে কোনও জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করতে পারবেন না। ’
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চট্টগ্রামের ৩২০ ইটভাটার মধ্যে ২৭৫টি পাহাড়বেষ্টিত উপজেলা সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, রাঙ্গুনিয়া, ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, রাউজান এবং চন্দনাইশে অবস্থিত। এই সাত উপজেলায় গড়ে ওঠা ৮০ শতাংশ ইটভাটার প্রধান কাঁচামাল মাটির যোগান আসছে পাহাড়ি মাটি বা টিলা থেকে। এছাড়া জ্বালানি হিসেবে এখনও বিভিন্ন ইটভাটায় ব্যবহার হচ্ছে পাহাড় থেকে কেটে আনা কাঠ।
পাহাড়ি অঞ্চলে ইটভাটা স্থাপনের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে বলে জানান গবেষকরা। এছাড়া এসব এলাকায় ইটভাটা থাকায় বায়ু দূষণের পাশাপাশি পাহাড় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বলেও দাবি তাদের।
ইটভাটার পরিবেশগত ক্ষতি নিয়ে গবেষণা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. অলক পাল। তিনি বলেন, ইটভাটার কারণে পরিবেশের কি ক্ষতি হচ্ছে- তা যাচাইয়ে আমরা বেশকিছু স্টাডি করেছি। ইটভাটায় যেসব কয়লা ব্যবহার করা হয় তা অত্যন্ত নিম্নমানের। এছাড়া তারা টায়ার ও গার্মেন্টের ঝুট কাপড় জ্বালিয়ে ইট পুড়িয়ে থাকে। ফলে ব্যাপক পরিমাণ বায়ু দূষণ হচ্ছে। ইটভাটায় পোড়ানো জ্বালানির ছাই উড়ে গিয়ে আশপাশে কৃষি উৎপাদনে প্রভাব ফেলছে। ইটভাটাবেষ্টিত এলাকায় কোনও ধরনের ফসল উৎপাদন হয় না।
তিনি বলেন, এসব এলাকায় বসবাসরত জনগোষ্ঠির ওপর স্বাস্থ্যগত প্রভাবও পড়ছে। এলার্জির সমস্যা ছাড়াও শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভুগছেন অনেকে। এসব ক্ষতি থেকে বাঁচার উপায় হতে পারে- পরিবেশ ঠিক রেখে বিকল্প পদ্ধতিতে ইট উৎপাদন।
২০২০ সালের ১৪ ডিসেম্বর পরিবেশ ও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষ থেকে ইটভাটা বন্ধে উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন করা হয়। আদালত এক সপ্তাহের মধ্যে অবৈধ ইটভাটা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। ২০২১ সালের ৩১ জানুয়ারি রিটের শুনানি শেষে পরিবেশ অধিদফতরের অনুমোদন ছাড়া চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা সবগুলো অবৈধ ইটভাটা বন্ধের নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। এরপর থেকে অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদের অভিযান শুরু হলেও অজ্ঞাত কারণে আবারও মাঝপথে থমকে যায় এ কার্যক্রম।
গত ২০ জানুয়ারি ডিসি সম্মেলনে আবারও অবৈধ ইটভাটা বন্ধের বিষয়টি উঠে আসে।
অবৈধ ইটভাটা বন্ধে জেলা প্রশাসন ২০২৫ সালের মধ্যে ইটভাটাগুলোকে শতভাগ পরিবেশবান্ধব ইট ‘হলো ব্রিকস’ উৎপাদনে যেতে নির্দেশনা দিয়েছে । ইতিমধ্যে ‘হলো ব্রিকস’ উৎপাদনে চট্টগ্রামের ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। যারা এই ইট তৈরিতে আগ্রহী তাদের লাইসেন্স দিতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এছাড়া ট্রেডিশনাল ইটভাটার নতুন লাইসেন্স দেওয়াও বন্ধ করা হয়েছে।
অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে প্রয়োজনীয় লোকবল না থাকায় কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারছে না পরিবেশ অধিদফতর। পরিবেশ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা না প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ইটভাটার মালিকরা বেশিরভাগই রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকেন। অভিযান পরিচালনা করতে গেলে বিভিন্ন তদবির শুরু হয়ে যায়। ফলে কোনও উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয় না। এছাড়া দুর্গম এলাকা হওয়ায় প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবে অভিযান পরিচালনা করা যায় না।
অভিযোগ রয়েছে, পরিবেশ অধিদফতরের লোকমান নামক এক ব্যাক্তি কর্তাদের জন্য ইটভাটা মালিকদের কাছ থেকে মাসোহারা নেয়। জানা গেছে, এই লোকমানের বাড়ী রাঙ্গুনিয়ায়। লোকমান সবসময় নিজেকে ড. হাসান মাহমুদের লোক পরিচয় দিয়ে চলত। ।
চট্টগ্রাম ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির আহ্বায়ক ইসমাইল হোসেন বলেন, প্রতিবছর প্রায় ৫০০ কোটি পিচ ইটের চাহিদা রয়েছে। গত জানুয়ারিতে প্রায় ৫০ শতাংশ ইটভাটা বন্ধ করে দিতে হয়েছে। এতে অনেক মালিক আর্থিক কষ্টে পড়ে গেছে। সমস্যা সমাধানে সরকারের কাছে আমরা আবেদনও করেছি। সরকার সুযোগ দিলে এই খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।