মোহাম্মদ ইলিয়াছ
পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত হয়ে আমরা পেয়েছি মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার আর একটি স্বাধীন সার্বভৌম জাতির স্বীকৃতি। একুশের রক্তাক্ত সেই স্মৃতিময় দিনটিকে কেন্দ্র করেই বিশ্বব্যাপী পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।দিনের পর মাস আসে, মাস পেরিয়ে বছর, সকলই পতিত হয় অনন্তকালের গর্ভে। কিন্তু জীবনে এমন কিছু ক্ষণ আছে, দিন আছে যা কখনোই বিস্মৃত হওয়ার নয়। প্রতি বছরই সেসব দিন আসে মানুষের তেচনাবোধকে সমৃদ্ধ করতে। তেমনই একটি গৌরবোজ্জ্বল দিন ২১ শে ফেব্রুয়ারি। মহান ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ভাষার জন্যে এতখানি ত্যাগ স্বীকার করেছে এমন জাতি পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই আপন সত্তা আবিষ্কারের মহিমা, অসাম্প্রদায়িক গণচেতনার বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে। ভাষা শহিদদের পবিত্র স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মিত হয়েছে জাতীয় মর্যাদার প্রতীক শহিদ মিনার। শহীদ মিনারের প্রতিটি ইট যেন প্রতিনিয়ত ঘোষণা দিচ্ছে বাংলা ও বাঙালির শৌর্য-বীর্যের।
‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলাভাষা!/তোমার কোলে, তোমার বোলে কতই শান্তি ভালোবাসা।’ মাতৃভাষা মা ও মাতৃভূমির মতই আমাদের বড়ই প্রিয়- তাই এদের উপর যখন আঘাত আসে, তখন আমরা সর্বশক্তি দিয়ে তাকে প্রতিহত করি। কারণ মাতৃভাষা নিঃশ্বাস বায়ুর মত আমাদের মানবিক সত্তার এক অপরিহার্য অংশ। বাংলাদেশের কৃষ্টি, সাহিত্য, সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে গভীর তাৎপর্যপূর্ণ জাতীয় চেতনার দিন অমর একুশ ফেব্রুয়ারি। এদিন আমাদের বাঙালি সমাজের রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন। বাঙালিত্বের চেতনার উন্মেষের উৎকৃষ্ট মানদন্ড একুশ ফেব্রুয়ারি। আজ বিশ্বও বাঙালির এ অস্তিত্ব-চেতনার স্বীকৃতি দিয়েছে। এ দিবসটি আজ আর শুধু বাংলাদেশের একক সম্পাত্তি নয়, পৃথিবীর ছোট বড় সকল ভাষাগোষ্ঠীর কাছেই এ দিনটি আসে নতুন প্রেরণা ও উৎসাহ নিয়ে। এ আমাদের জন্যে বড়ই আনন্দের, বড়ই গর্বের।
একুশ মানে প্রতিজ্ঞা, একুশ মানে মাথা নত না করা। একুশ আমাদের মুক্তির চেতনা। একুশের চেতনা আমাদের মনের চেতনা। সাহিত্যে একুশের চেতনা জাগ্রত হয়েছে সর্বাধিক। বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতি-কৃষ্টির সঙ্গে এ চেতনা মিশে আছে স্বাভাবিকভাবে। প্রগতিশীল লেখকগোষ্ঠী এ ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই সাহিত্যের বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন। কথাসাহিত্য, নাটক, ছোটগল্প, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ, গান অর্থাৎ সাহিত্যের প্রতিটি ধারায় একুশের চেতনাকে তুলে ধরেছেন এদেশের সচেতন লেখকসমাজ। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার জন্যে যে তরুণেরা রক্তের অঞ্জলি দিয়েছিলেন তা উত্তরকালে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যের ধমনীতে নিত্য সক্রিয় রয়েছে।
হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, সিকান্দার আবু জাফর, মুনীর চৌধুরী, আবুল ফজল প্রমুখ কবি-সাহিত্যিক ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশ-কাল-সমাজের সমকালীন কালপুরুষের দিকে যাত্রা করেছেন। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি… না, আমরা ভুলতে পারি না। আমি না। আমরাও না। কোনো বাঙালিই ভুলতে পারে না। ভুলতে পারবে না কোনোদিন। কেন ভুলব? সেদিন রাজপথে রক্ত ঝরেছে আমার ভাইয়ের। মায়ের ভাষার জন্য লড়াই করেছেন তারা। প্রাণ দিয়েছেন অকাতরে। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর, আউয়াল, অহিউল্লাহ- বাংলা মায়ের অমর শহীদ ছেলে। বুকের রক্ত দিয়ে তারা লিখেছেন বাঙালির পালটে যাওয়ার নতুন ইতিহাস। সেদিনের বাংলাভাষার দাবি থেকেই আজকের বাংলাদেশ। নিজের ভাষায় কথা বলা। স্বাধীন দেশে পথচলা
একুশ মানে এগিয়ে চলা। একুশ মানে মাথা নত না করা। একুশ আমাদের চেতনার শেকড়। একুশ আমাদের গর্ব। একুশ আমাদের অহঙ্কার। তাই প্রতি বছর আমরা একুশ পালন করি শোকের শক্তিকে শাণিত করতে। আমাদের মনে রাখতে হবে- শুধু আবেগে দিনটি পালন নয়।
দিনটিতে নয় কোনো আনন্দ উৎসব। এটি মহান শহীদ দিবস। এটা যেমন শোকের দিন, তেমনি শক্তি আর সাহসের অপরাজেয় বরাভয়। খালি পায়ে প্রভাতফেরির দিবস। শহীদ মিনারে ফুলের শ্রদ্ধা নিবেদনের দিন। বাঙালি চেতনায় অনড় শপথের দিন। শুধু একদিন নয়, প্রতিদিন যাপনে একুশকে ধারণের দিন। আর তাই জানতে হবে একুশের ইতিহাস।
অমর কেন একুশ? একুশে ফেব্রুয়ারি? এ দেশ ছিল আগে পাকিস্তানের শাসনে। পশ্চিমা শাসকরা তাদের উর্দু ভাষায় কথা বলাতে চেয়েছিল আমাদের। বাঙালির প্রাণের ভাষা বাংলার টুঁটি চেপে ধরতে চেয়েছিল তারা।
প্রতিবাদে বাঙালির ভাষা-বিক্ষোভ শুরু হয় ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে। তারপর চরম প্রকাশ। সেদিন ১৯৫২ সাল। একুশে ফেব্রুয়ারি। সকালবেলা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভেঙে ফেলে। আন্দোলনে নেমে পড়ে রাজপথে। পুলিশ গুলি চালায় তাদের ওপর। রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ। নাম জানা-অজানা শহীদ হন অনেকেই। ক্ষুব্ধ ঢাকা। উত্তাল সারা দেশ। পরদিন আবার রাজপথে বিক্ষুব্ধ আন্দোলন। এবার ছাত্রদের পাশে নামেন সাধারণ মানুষ। শহীদদের জন্য অনুষ্ঠিত হয় গায়েবানা জানাজা।
২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে একরাতেই গড়ে ওঠে স্মৃতিস্তম্ভ- শহীদ মিনার। ২৬ ফেব্রুয়ারি তা গুঁড়িয়ে দেয় সরকার। তারপরও ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয়। অবশেষে ১৯৫৪ সালের ৭ মে গণপরিষদের অধিবেশনে এ দেশের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পায় বাংলা। সেই থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি জাতীয় শোক দিবস। এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে জাতীয় শহীদ মিনার সেই শোকের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বাঙালির মাতৃভাষাকে ভালোবাসার চেতনা আজ ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। একুশ এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এ অর্জন বাঙালির। বাংলাদেশের। ১৯৯৮ সাল। জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান। তার কাছে আবেদন করা হয় একুশকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার জন্য। এর প্রাথমিক উদ্যোক্তা কানাডা প্রবাসী দুই বাঙালি- রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম।
পরের বছর ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর প্যারিসে অধিবেশনে সেই স্বীকৃতি মিলল। একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘোষণা করা হল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। ২০০০ সাল থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোতে পালিত হচ্ছে।
একুশের চেতনা কী? আর তরুণরা সেই চেতনা ধারণ করে কিভাবে? শুধু তরুণ নয়, আমাদের সবাইকে প্রথমেই মনে রাখতে হবে- একুশ কোনো আনন্দ উৎসব নয়। শহীদ ভাইদের রক্তঝরা দিন। একুশের চেতনা মানে সেজেগুজে হাত ধরাধরি করে ঘুরে বেড়ানো নয়।
নেচে-গেয়ে মাতামাতি নয়। শহীদ মিনারে ফুল দিতে গিয়ে হইহুল্লোড় নয়। মজা করে পিঠা-পায়েস আর ফুচকা চটপটি খাওয়ার দিন নয়। বাংলা ইংরেজি হিন্দি মিলিয়ে জগাখিচুড়ি ভাষা নয়। একুশ মানে একদিন নয়। প্রতিদিন। শুদ্ধ বাংলা বলা। শুদ্ধ বাংলার চর্চা। সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন। শহীদ দিবস যথাযথ পালন।
বাঙালি জাতির অহংকার এই একুশের চেতনা বুঝতে হলে সঠিক ইতিহাস জানতে হবে। পটভূমি বুঝতে হবে। একটি ভাষা আন্দোলন কিভাবে একটি দেশকে স্বাধীনতার পথ দেখাল তার মর্ম অনুভব করতে হবে। সব তরুণ সমান নয়। কারও কারও বুকে রয়েছে ভাষার জন্য দেশের জন্য তুমুল ভালোবাসা। আর এ তরুণরাই পারবে। সামনে অনেক সম্ভাবনা। আমাদের দেশের তরুণরা অনেক এগিয়েছে নানা ক্ষেত্রে।
লেখাপড়া, ব্যবসা-বাণিজ্য, খেলাধুলা, বিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতি, আইটি আরও কত জায়গায় তারা ভালো করছে। এই তো কদিন আগে বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে আমাদের কয়েকজন তরুণ। ক্রিকেটে বিশ্বকাপ জিতেছে তারা।
আমাদের আগামী প্রজন্ম নিশ্চয় একুশের চেতনা সঠিকভাবে বুকে ধারণ করবে। আর সেই চেতনায় গেয়ে উঠবে- আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই। আমি আমার আমিকে চিনি এই বাংলায়।
ভাষা শহিদদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে বাংলাকে আমরা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পেয়েছি। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জাতি হিসেবে আমাদের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। ভাষার চেতনা ও স্বাধিকার বোধের চেতনায় বিকশিত হয়ে আমরা ১৯৭১ সালে অর্জন করেছি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। আজ স্বাধীনতা অর্জনের দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। অথচ আমরা এখনও একটি আলোকিত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারিনি।
একজন শিক্ষক হিসেবে আমি খুব মর্মাহত হই, যখন দেখি ভাষার প্রতি অবহেলা, অবজ্ঞা, ইংরেজি স্টাইলে বাংলা উচ্চারণ, অশুদ্ধ উচ্চারণ, অজস্র বানান ভুলের প্রবণতা। তখন মনে পড়ে যায় মধ্যযুগের এক প্রতিবাদী ও সংগ্রামী কবি আবদুল হাকিমের কবিতার কথা-
“যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।”
আলো চাই আলো। এক চিলতে আলো থেকে বেরিয়ে আসুক সোনালি সকাল। সম্প্রীতির মলাটে, সৌহার্দ্যরে বর্ণমালায়, সহাবস্থানের শব্দ চয়নে রচিত হোক সম্ভাবনার বাংলাদেশ। এবারের একুশের কাছে রইল এমন প্রত্যাশা।লেখক : সহকারী পরিচালক ( অর্থ ও বাজেট), অবসর সুবিধা বোর্ড, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা।