এম. আলী হোসেন
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখন সারা দুনিয়ার চোখ বাংলাদেশের দিকে । আমেরিকার উল্টো চোখে ভারত, চীন ও রাশিয়া দেখছে বাংলাদেশকে।অন্য দেশ ও জাতীয় সংঘও আমেরিকা বলয়ে মাথা নাড়ছে।রেমিটেন্স আদায়ের দেশ কাতার, কুয়ে্ত, দুবাই, মালয়েশিয়া ও সৌদি আরব মুখ না খুললেও চোখ খোলা রেখেছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে। ‘১৪ ও ‘১৮ সালের চেয়ে কুটনৈতিক তৎপরতা ছিল এবারকার নির্বাচনে বেশী।বিদেশ নির্ভর এই নির্বাচন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে অতি গুরুত্বপূর্ণ ।
কারো মতে উৎসব আবার কারো মতে ভয় -ভীতি, সংকট ও বর্জনের নির্বাচন এটি। সকাল-সন্ধ্যা ‘লকডাউন’ কর্মসূচির ডাক ছিল এবি পার্টির।বিএনপি, জামাত, জাসদ, গণ অধিকার পরিষদ, এলডিপি, খেলাফত মসলিশ, লেবার পাটিসহ অভিন্ন কর্মসুচী ভোট বর্জন ও হরতালের সপক্ষে ছিল এই নি্র্বাচন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জাতীয় পার্টি- জেপি (মঞ্জু), কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, গণতন্ত্রী পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এম.এল), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ (ইনু), জাকের পার্টি, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), গণফ্রন্ট, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (মুকিত), ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট (মুফতী আমিনী প্রতিষ্ঠিত), বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল), বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট (মুক্তিজোট), বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ), বাংলাদেশ কংগ্রেস, তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম), বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি), জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম) ও গণফোরাম।দ্বাদশ নির্বাচনে উৎসমূখর পরিবেশ কায়েমে সদা অবিচল ।এরই মধ্যে জাতি ও গোটা বিশ্ব দেখল দ্বাদশ নির্বাচন।
দ্বাদশ নির্বাচন অনুষ্ঠানের একদিন আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, পৃথিবীর কোন দেশে শতভাগ গণতন্ত্র নেই।মনওয়েলথ পর্যবেক্ষক পাঠিয়েছে, এটা আমাদের জন্য আনন্দের।‘বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নির্বাচন কমিশন গঠনে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। যার অধীনে সাংবিধানিক পদের অধিকারীদের সমন্বয়ে সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইলেকশন কমিশনের প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এই কমিশন সর্বোচ্চ স্বাধীনভাবে কাজ করছে।’
গভীর উদ্বেগ ও শঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। সেইসঙ্গে তারা নির্বাচনকে প্রত্যাখান করে খোলা চিঠি দিয়েছে ।
খোলা চিঠিতে তারা বলেছে সারাদেশ এক প্রকট রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়েছে, যা প্রকারান্তরে একটি সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র হিসেবে বাংলাদেশের সামগ্রিক অস্তিত্বের প্রশ্নটিকেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে যারাই ক্ষমতায় যাক না কেন, জনগণের কাছে তাদের কোনো জবাবদিহি থাকে না, দায়বদ্ধতা থাকে না। এরকম শাসনব্যবস্থায় দ্রব্যমূল্যের অযৌক্তিক ও আকস্মিক বৃদ্ধিতেও সরকার তো তার দায় স্বীকার করেই না, উল্টো জনমানুষের দুর্ভোগ নিয়ে নিয়মিত মিথ্যাচার অথবা উপহাস করতেও পিছপা হয় না।এতে দুর্নীতিগ্রস্ত আর অসৎ মানুষদের আইনের আওতায় আনা যায় না। তারাই সাধারণত সরকারি দলের ছায়াতলে থেকে শত অপরাধ করেও আরামে-আয়েশে নির্বিঘ্নে জীবন-যাপন করে।
খোলা চিঠিতে বলা হয়, ‘আবার তাদের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে বেশি প্রভাবশালী অংশ, দেশের ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়ে অর্থ শোধ করে না এবং দেশের মানুষের অর্থ বাধাহীনভাবে বিদেশে পাচার করতে থাকে। ফলে সৎ ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষের প্রতিদিনের স্বাভাবিক জীবন-যাপন হয়ে উঠছে দুরূহ ও দুঃসহ এবং সার্বিকভাবে সাধারণ জনগণের ন্যায্য অধিকার ও নিরাপত্তা খর্ব হতেই থাকে; সর্বজনের উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষা সরকারি নীতিতে প্রতিফলিত হতে পারে না।
গত ১০ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে যে, প্রশ্নবিদ্ধ আগের দুই নির্বাচন এদেশে বস্তুত একটা একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা কায়েমের পথ সুগম করেছে। এই সময়কালে এ দেশের মানুষের সাংবিধানিক অধিকারগুলো, বিশেষ করে মতপ্রকাশ ও সমাবেশের স্বাধীনতা এবং মৌলিক মানবাধিকার নির্মমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের গুম, খুন, গুপ্ত হত্যা করার মতো গুরুতর অপরাধকেও স্বাভাবিক করে ফেলা হয়েছে। এতে আইনের শাসন ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। একইসঙ্গে সম্পদের অসম বণ্টন, পক্ষপাতিত্বমূলক বিচারপ্রক্রিয়া এবং সরকারি দল ও প্রশাসনের দমনপীড়ন দেশকে এক আতঙ্কের জনপদে পরিণত করেছে।
আমরা আশা করেছিলাম, এসব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সর্বজনের সমঝোতার ভিত্তিতে একটি অবাধ, প্রতিযোগিতাময় ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের প্রচেষ্টা সবার মধ্যেই থাকবে। কিন্তু আমাদের হতাশ হতে হয়েছে। আগামী ৭ জানুয়ারি যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তা বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর নিরঙ্কুশ ক্ষমতার নবায়ন ব্যতীত আর কিছুই জনগণকে দিতে পারবে না।
একটি শক্তিশালী বিরোধীদলের উপস্থিতি সংসদীয় শাসন পদ্ধতির অন্যতম পূর্বশর্ত হওয়া সত্ত্বেও অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আগের মতো একটা ‘পুতুল’ বিরোধী দলও গড়ে তোলা মুশকিল হয়ে যাবে। কারণ, অবাধ নির্বাচনের পরিবেশ অনুপস্থিত বলে বিএনপিসহ ৬৩টি রাজনৈতিক দল এ নির্বাচন বর্জন করেছে। সরকারি দলের সঙ্গে বা সরকারি দলের সমর্থন নিয়ে যে দলগুলো দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, সেগুলো নামেমাত্র ভুঁইফোড় রাজনৈতিক সংগঠন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে এসব সংগঠনকে পরিকল্পিতভাবেই রেজিস্ট্রেশন দিয়েছে।
তারা বলছে, মিডিয়ার প্রতিবেদনগুলো সাক্ষী, আসনগুলো নির্বাচনের আগেই ভাগাভাগি হয়ে গেছে! জাতীয় পার্টি ভাগ পেয়েছিল ২৬টি আসন আর সংসদে ‘বিরোধী দল’ হওয়ার আশ্বাস। কিন্তু ইতোমধ্যে তাদের ২৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছে দমনপীড়নের অভিযোগ তুলে। বাদবাকি যে প্রার্থীরা নির্বাচনে আছেন, তারা প্রায় সবাই সরকারি দলের। সরকারি দল একটা প্যানেল দিয়েছে, আবার বিস্ময়করভাবে, নিজের দলেরই সদস্যদেরকে ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়ানোর অনুমোদন দিয়ে দিয়েছে। বিরোধীদের নির্বাচন বয়কটের চাপ সামলাতে এবং এ নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দেখাতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশক্রমে নিজের দলেরই সদস্যদের ‘ডামি’ প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন! এ ঘটনা নজিরবিহীন। ফলে, বলা যায়, এ নির্বাচন এমন এক কৌশলে হতে চলেছে, যে বা যারাই নির্বাচনে জিতুক না কেন তাদের সবাই হবে ক্ষমতাসীন দলের লোক!’