বিপ্লব কান্তি নাথ
যিনি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিলেন সর্বদা। বাংলাদেশের সংসদে ও টেলিভিশন টকশোতে সব সময় সরব ছিলেন এই মহান নেতা। যিনি সংসদে বসে তার বক্তব্যে সরকার দল ও বিরোদী দলীয় ভূমিকায় ছিল বিচক্ষণ। বাংলাদেশের রাজনীতি-সংবিধান যার নখেদর্পণে মুখস্ত।
সংসদেও বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ছিল তার। প্রতিটি সংসদ অধিবেশনেই সপ্রতিভ ক্ষুরধার বক্তব্য রাখতেন তিনি।
একাত্তরের রণাঙ্গনে জীবনবাজি রেখে লড়েছেন দেশমাতৃকার জন্য।
একাদশ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণমাধ্যম সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকালে তিনি জানিয়ে ছিলেন, মৃত্যুর জন্য সর্বদা প্রস্তুত ছিলেন এমপি বাদল।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জোট অংশ নেবে কিনা এমন এক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল সে সময়।
সেই বিষয়টিকে কেন্দ্র করেই মঈন উদ্দীন খান বাদলের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন গণমাধ্যম সাংবাদিক।
এ সময় রাজনীতিবিদ হিসেবে নিজেকে কতটুকু সফল বলে মনে করেন, জবাবে বাদল বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের জেনারেল সুজন সিংহবানের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম আমরা। উনি হেডকোয়ার্টার করেছিলেন রাঙামাটি। আমি আর প্রয়াত ছাত্রনেতা এসএম ইউসুফ তার কাছে গেলাম একদিন। তিনি বললেন, বাচ্চা ‘চা পিয়ো’(চা খাও)।
চা খেতে খেতে মেজর জেনারেল (অব.) সুজন সিং উবান বলছিলেন, দেখো নিজেকে এমনভাবে তৈরি করবে যেন যেকোনো পরিস্থিতিতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার মানসিকতা থাকে। তবেই তুমি একজন ভালো যোদ্ধা হবে। তোমাকে প্রস্তুত থাকতে হবে। তোমার মৃত্যুতে কেউ চোখের পানি ফেলবে না। কেউ শোকবার্তা দেবে না। এ রকম নীরবে যদি মরে যেতে পার, তবেই তুমি একজন আসল যোদ্ধা।
সুজনের সেই নিদের্শনাটি তার কানে এখনও বাজে বলে জানিয়েছিলেন এমপি বাদল।
তিনি বলেছিলেন, সুজন সিং উবানের কথাটি আমার হৃদয়ে দাগ কেটেছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সেই মানসিকতা নিয়েই যুদ্ধ করেছি। জয়লাভ করেছি। সেই থেকেই আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। খালি হাতে এসেছিলাম। খালি হাতেই যাব।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের অবিস্মরণীয় অসাধারণ এক উক্তি ছিল ‘আমার বাংলাদেশের আমার মানুষেরা যার যার ধর্ম তারা নির্বিগ্নে, নিঃসংকোচে, আনন্দের সাথে পালন করিবে’। বঙ্গবন্ধুর আলোচিত এই উক্তিকে বুকে ধারণ করে তা বাস্তবায়নের জন্য জীবনের অন্তিমকাল পর্যন্ত সোচ্চার কণ্ঠে কাজ করে গেছেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী একাত্তরের রণাঙ্গনের সৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা মইন উদ্দীন খান বাদল। যখনই দেশে জাতিতে-জাতিতে বিভেদ, ধর্মে-ধর্মে বিভেদ দেখা দেয়; তখনি তার সোচ্চার কণ্ঠে স্পর্ধিত উচ্চারণ-বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। এই বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান হবে না।
বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ছাত্রলীগের রাজনীতির মাঠ থেকে উঠে আসা ছাত্রনেতা মঈন উদ্দীন খান বাদল ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর আহবানে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন সংগঠক হয়েও সমর যুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেন, চট্টগ্রাম বন্দরে নৌ-কমোডরদের সাথে নিয়ে অপারেশন জ্যাকপটের পরিকল্পনা ও সফল অপারেশনের মাধ্যমে ৭ টি পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে পাকিস্তানিদের মনোবল ভেঙে স্বাধীনতা অর্জন ত্বরান্বিত করতে সক্ষম হয়। ১৯৭২ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ এ যোগদান করেন।
বিগত ২০১৭ সালে যখন মায়ানমারে মুসলিম রোহিঙ্গা নিধন ইস্যুতে বাংলাদেশে বৌদ্ধ সাম্প্রদায়ের উপর হামলা হয়, তখন জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি-আকর্ষণ করে আঙ্গুল উঁচিয়ে বিরোচিত কন্ঠে বলেন- আজ জাতির কাছে আমার প্রশ্ন এই জন্যই কি আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম? আমরা জীবনের ঝুকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম বাঙ্গালীর জন্য একটি দেশ করবো বলে। এই বাংলার মাটিতে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান মিলে-মিশে থাকবো বলে। মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম একটি ধর্ম নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশ করবো বলে। এই কথা গুলো সরকার শাসনতন্ত্রে সন্নিবেশ করবেন। ধর্ম নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম বলে আমরা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম। আজ এই মূলনীতির বিরুদ্ধে যদি কেউ দাঁড়ায় তাকে ছাড় নয়। প্রয়োজনে আমরা আবারো ঝাঁপিয়ে পড়বো। তবুও এই দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুন্ন রাখবো। এটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব। নাগরিক হিসেবে এই বিষয়ে আমি সবসময় সোচ্চার থাকবো।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে কয়জন প্রবীণ রাজনীতিবিদ জাতীয় অমীমাংসিত ইস্যুগুলো নিয়ে কাজ করেছেন তার মধ্যে মঈন উদ্দীন খান বাদল ছিলেন অন্যতম একজন জাতীয় নেতা। তিনি শুধু একজন স্বাধীনচেতা রাজনীতিবিদ ছিলেন না, ছিলেন একজন বড় মাপের দার্শনিকও। তাঁর রাজনৈতিক পুরো চিন্তা চেতনার দিকদর্শন ছিল গণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন, দেশের সার্বিক উন্নয়ন, জাতীয় ইস্যুগুলোতে তাঁর বীরোচিত ভাবগাম্ভীর্য পূর্ণ ভূমিকা রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মাত্রা যোগ করত, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে সংসদীয় রীতি-নীতি পালনে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন এই বীর পুরুষ।
রাজপথ থেকে সংসদ সর্বত্রই সমান বিচরণ করা এই মানুষটি তেমন বড় কোন রাজনৈতিক দলের নেতা না হলেও বিশাল কর্মী বাহিনী না থাকলেও তাঁর রাজনৈতিক দর্শন, মেধা, যোগ্যতা, নেতৃত্বের প্রতিফলন ঘটিয়ে নিজেকে যোগ্য জাতীয় নেতা হিসেবে স্থান করে নিতে পেরেছেন কোটি জনতার হৃদয়ে। মঈন উদ্দীন খান বাদল এক নামেই দেশের মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে উঠে। এটিই ছিল তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় সার্থকতা। এখনো তার শূন্যতায় কোটি হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়।
গণ মানুষের অধিকার আদায়েও সোচ্চার ছিলেন বর্ষিয়ান এই রাজনীতিবীদ, ২০০৮ সালে তিনি ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনিই সর্বপ্রথম কর্ণফূলী নদীর উপর কালুরঘাট সেতু নির্মাণের গুরুত্ব ও দাবি আনুষ্ঠানিক ভাবে জাতীয় সংসদে প্রস্তাবনা উপস্থাপন করে, এর পর থেকে সেতু নির্মাণের দাবিতে কখনো রাজপথ, কখনো সংসদ সবখানেই সোচ্চার ছিলেন তিনি। সর্বশেষ ২০১৯ সালের শুরুতে জাতীয় সংসদের একাদশ অধিবেশন চলাকালীন পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে বলেন, আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে যদি কালুরঘাট সেতু নির্মাণে দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি না হয়, “আই উইল গো আউট ফ্রম দ্যা পার্লামেন্ট”।
হ্যাঁ সত্যিই তিনি তাঁর কথা রেখেছেন, ডিসেম্বরে আর তাঁকে পার্লামেন্টে যেতে হয়নি, তার আগেই ৭ নভেম্বর ২০১৯ সালে চলে গেলেন। ২০১৯ সালে ৭ নভেম্বও বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে ভারতের বেঙ্গালুরুর নারায়ণ হৃদরোগ রিসার্চ ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে তিনি মারা যান।
মইন উদ্দীন খান বাদল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আহমদ উল্লাহ খান ও মা যতুমা খাতুন।
মঈন উদ্দীন খান বাদল বোয়ালখালী উপজেলা জাসদের সভাপতি ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম-৮ আসনের তিন বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। তার তিন ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।
প্রয়াত সাংসদ মঈন উদ্দীন খান বাদল যার প্রতিটি উক্তি, দেশপ্রেম, পার্লামেন্টের কন্ঠস্বর পত্রিকা ও বিভিন্ন টেলিভিশন টকশো আর দেখা ও শোনা যায় না, ভাল থেকে পরপারে হে বীর। লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক সাধারণ সম্পাদক, রুদ্রজ ব্রাহ্মণ পুরোহিত সংঘ,বাংলাদেশ, কেন্দ্রীয় সংসদ।