মো. আবদুর রহিম
পাকিস্তানের শাসন-শোষণ বঞ্চনা নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মূল কেন্দ্র বিন্দু ঢাকা ধানমন্ডির ৩২নং সড়কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাড়ি। ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে এই বাড়িতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। এই বাড়ি থেকে পাকিস্তানী সামরিক জ্যান্তা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পাকিস্তান। এই বাড়িটি বাংলার ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক সাক্ষী। এই বাড়িতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে ঘাতকচক্র। জাতির পিতা যেদিন সপরিবারে ঘাতকের বুলেটে শহীদ হন তখনও তিনি মহামান্য রাষ্ট্রপতি। বিনা বাধায় খুনিরা মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও জাতির পিতার বাড়িতে প্রবেশ করে একে একে হত্যা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, বঙ্গবন্ধু সহধর্মিনী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর তিন পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, পুত্রবধু সুলতানা কামাল, রোজি জামাল ও ছোট ভাই শেখ নাসের সহ অন্যদের। এই সময়ে অন্য দুই বাড়ি বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি, মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও ভাগিনা শেখ ফজলুল হক মনির বাড়ি আক্রান্ত হয়। আবদুর রব সেরনিয়াবাত, ৪ বছরের শিশু সহ একই বাড়িতে ৮ জন এবং শেখ ফজলুল হক মনি ও তাঁর স্ত্রী অন্তঃসত্তা আরজু মনিকে হত্যা করে ঘাতকরা। এছাড়া জাতির পিতার বাড়িতে পুলিশের এসবি শাখার ইন্সপেক্টর ছিদ্দিকুর রহমান ও বঙ্গবন্ধুর ডাকে তাকে বাঁচাতে আসার পথে ঘাতকের বুলেটে জীবন যায় বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা কর্মকর্তা বিগ্রেডিয়ার জামিল যার পরিচয় কর্ণেল জামিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ঘাতকের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পর বহু স্থানেই ফোন দেন কেউই সাড়া দেয় নাই। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর ভোরে যখন ঢাকার মসজিদগুলোতে আযান হচ্ছে ঠিক সেই সময় ঘাতকরা জাতির পিতার বুকে চালায় নৃশংসগুলি। হত্যা করে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। স্তব্ধ করে দেয়া হয় তাঁর বজ্রকণ্ঠ। বিশাল হৃদয়ের এই মহান নেতাকে বিশে^র বিশ^নেতারা সম্মান করত সমীহ করত, শ্রদ্ধা জানাত। ১৯৭১ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে নেতা শেখ মুজিব লন্ডন পৌঁছালে সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানায়। যে নেতা জাতিসংঘে বক্তৃতা দিতে উঠে বাংলায় বক্তৃতা দেয়ার ইচ্ছা জানালে জাতিসংঘের অধিবেশন কিছু সময় মুলতবি রেখে বাংলায় বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। যে মহান নেতা নিজ স্বাধীন দেশে আসার পূর্বে মিত্র বাহিনীর সেনাদের ফিরিয়ে নিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে রাজি করিয়ে নিজ দেশে পা রাখেন। যে নেতা পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে একটি জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। সেই মহান জাতীয় বীরকে নিজ দেশে স্বজাতির কতিপয় বিপথগামী সেনা সদস্যের হাত নির্মমভাবে জীবন দিতে হলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৭ থেকে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত পাকিস্তানীদের কারাগারে ৪৬৮২ দিন নির্যাতনের শিকার হন অথচ পাকিস্তানীরা তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারার সাহস করেনি। যে নেতার একটি অঙ্গুলি হেলনে বাংলার ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে উঠে, যে নেতার নির্দেশে বাংলার মানুষ যুদ্ধ করে ৩০ লক্ষ প্রাণ বিসর্জন দিয়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে। যে নেতার নির্দেশে দেশের ২ লক্ষ ৬৯ হাজার নারী সম্ভ্রম বিসর্জন করে, যে নেতার নির্দেশে দেশ স্বাধীনতা করতে এক কোটি মানুষ ভারতের শরণার্থী শিবিরে ৯ মাস মানবেতর জীবন কাটায়, যে নেতার আহŸানে স্বাধীনতার জন্য দেশের ৩ কোটি মানুষ তাদের ঘর-বাড়ি, সহায় সম্পদ উৎসর্গ করে নিঃস্ব হয়ে যায়। সেই নেতাই তাঁর স্বজাতির হাতে সপরিবারে প্রাণ গেল। এই যে ট্রাজেডি, এই যে বিভীষিকা, এই যে নিষ্ঠুরতা, এই যে, বর্বরতা, এই যে হিংসার বহি:প্রকাশ তাঁর পেছনে কারা। কারা বঙ্গবন্ধু হত্যার নীলনক্সাকারী, কারা বাস্তবায়নকারী, এই হত্যার পেছনে কোন কোন দেশ জড়িত। কেন এই নৃশংসতা? তাঁর সঠিক উত্তর আজো জাতি পুরোপুরি জানে না। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ কেন হলো? কেন ইনডেমনিটি জারি হলো ? কেন খুনিদের সূর্য সন্তান অ্যাখ্যায়িত করে দেশ-বিদেশে পুনর্বাসন করা হলো? কেন খুনিদের রাজনৈতিক দল গঠনের সুযোগ দেয়া হলো ? কি কারনে খুনিদের মহান জাতীয় সংসদে বসানো হলো ? কারা কেন ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের কেন স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল গঠন করে ক্ষমতার অংশীদার করা হলো ? কারা যুদ্ধপরাধীদের মন্ত্রী, এমপি বানিয়ে দেশের সংবিধান, জাতীয় পতাকা কলঙ্কিত করলো? তারা কারা? কারা কুখ্যাত গোলাম আজমকে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসে ? কারা শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে আসীন করে? কারা খুনি, যুদ্ধাপরাধীদের বাড়িতে গাড়িতে, অফিসে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত ভেজা জাতীয় পতাকা তুলে দিয়ে জাতিকে অপমানিত করে? তাঁদেরকে জাতি কি চিনে না? বীরের জাতির ললাটে এই যে কলংকের তিলক এঁটে দিল সে কে ? খুনি জিয়াউর রহমান, তাঁর স্ত্রী খালেদা ও তাঁর পুত্র তারেক নয় কি ? ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট জাতির পিতার রক্তের উত্তরাধিকার তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্যই গ্রেনেড হামলা নয় কি ? সেই দিনের গ্রেনেডের আঘাতে নিহত আইভি রহমানসহ ২৪ জনের জীবন প্রদীপ সংহার কি খালেদা তারেক করেনি? রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে, এই নৃশংসতা কি তাদের কাজ নয়? সেই গ্রেনেড হামলায় নিহত আহত ও পঙ্গু মানুষগুলোর রক্ত কি খালেদা তারেককে ক্ষমা করতে পারে ? নিষ্ঠুর হত্যা, জঙ্গী হামলা, সন্ত্রাস, মানুষ খুন যাদের চরিত্র, যে রাজনীতি সন্ত্রাস জন্ম আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়। জঙ্গীবাদ জন্ম দেয়, যে রাজনীতি চলন্তবাসে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা করে, যে রাজনীতি ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে, যে রাজনীতি দেশের সম্পদ বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়, যে রাজনীতি স্বজাতির সুনাম নষ্ট করে, যে রাজনীতি গুজব মিথ্যাচার ছড়ায়, সে রাজনীতি প্রতিপক্ষের ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকান পাট, জায়গা-জমি পুকুরের মাছ, জমির ফসল হরিলুট করে, যে রাজনীতি কি আমাদের কাম্য। স্বাধীনতার ৫২ বছর, বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর ৪৮ বছর, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলার পর ১৯ বছর পার হলো। এর মধ্যে এসএম কিবরিয়া, আহসান উল্ল্যা মাস্টার, মমতাজ, বালু’র মত ২৩ হাজার নর-নারীর জীবন, ফাহিমা, মহিমা-দের ইজ্জত লুণ্ঠনের মত বিভীষিকা, জঙ্গী, বাংলা ভাইদের সন্ত্রাস, আগুন সন্ত্রাসের শিকার পঙ্গু মানুষদের আর্তনাদ কি শেষ হয়ে গেছে? ১৯৭১ এর সপ্তম নৌবহরের হুমকি, জাতির পিতার জীবন সংহারের কথা কি জাতির ভুলে গেছে ? ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তো একই সূতায় গাঁথা ষড়যন্ত্রের ফসল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন, কর্ম ও এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ও অভিন্ন। তাঁর কর্মময় জীবনের ইতিহাসের সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মহান এই মানুষটি জীবনে যা করেছেন সবই ছিল দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল দেশের নিপীড়িত, নির্যাতিত ও অবহেলিত মানুষের স্বার্থে। স্ত্রী, কন্যা, পুত্র ও পরিবারের জন্য তাঁর কোনো সময় বরাদ্ধ ছিল না। অপরিসীম ত্যাগের মহিমায় তাঁর জীবন মহিমান্বিত। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ সৃষ্টি হতো না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমান হয়তো সশরীরে আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর আদর্শ বাঙালি জাতির হৃদয়ে চিরজাগ্রত আছে। তিনি অমর, তিনি বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায়। ২০২৩ সালে আবার সামনে এসেছে ১৯৭১, ১৯৭৫ ও ২০০৪ সালের সেই ষড়যন্ত্র। বঙ্গবন্ধুর বাংলায় আবার আকাশে কালো মেঘ। বঙ্গবন্ধু কন্যা সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চার পাশে ষড়যন্ত্র, মিরজাফর, মোস্তাক, জিয়া তারেকদের আনাঘোনা, সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে আবার হানি দিতে প্রস্তুত। এই কঠিন ও দুঃসময়ে বঙ্গবন্ধু’র বাংলার দুঃখী মানুষদের কি ভরসা? বাংলার দুঃখী মানুষের একমাত্র ভরসা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। যারা এখনও মাইনাম ফরমূলা বাস্তবায়ন চায়। যারা ১/১১’র মত পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়। তাদের বিষদাঁত ভাঙ্গতে আসুন প্রজন্ম, আসুন দুঃখী জনতা, আসুন বঙ্গবন্ধুর বাংলার দেশপ্রেমিক ঈমানদার ভাই-বোনেরা এই আগস্ট মাসে আমরা শপথ গ্রহণ করি Ñ বঙ্গবন্ধুর বাংলায় গণতন্ত্র, আইনের শাসন, উন্নয়ন-সমৃদ্ধি আমরা অব্যাহত রাখবো। ষড়যন্ত্র প্রতিহত করবো।