মাহমুদুল হক আনসারী
জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখবে চট্টগ্রামের টানেল। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে দেশের প্রথম যোগাযোগ পথ ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’-এর নির্মাণকাজ প্রায় শেষের দিকে। এই টানেল চালু হলে দেশের অর্থনীতির চাকা আরও গতিশীল হবে । টানেলটি চালু হলে চট্টগ্রামসহ সারা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। টানেলের কারণে মিরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিনিয়োগের বিশাল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আবার টানেল ব্যবহার করে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ সারা দেশের কারখানার পণ্য কক্সবাজারের মাতারবাড়ী সমুদ্র বন্দরে আনা-নেওয়া করা যাবে দ্রুত সময়ে।
সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় দৈনিকে বলা হয়েছে, যান চলাচলের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। টানেলের রাস্তা এবং অ্যাপ্রোচ রোডসহ যাবতীয় কাজই শতভাগ শেষ হয়েছে। তবে সার্ভিস এরিয়ায় কিছু কাজ বাকি রয়েছে। যা যান চলাচলে কোনো প্রভাব ফেলবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২৮ অক্টোবর টানেল উদ্বোধন করবেন। এটি দক্ষিণ এশিয়ার নদীর তলদেশে প্রথম টানেল।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্দর নগরীকে চীনের সাংহাই নগরীর আদলে ‘ওয়ান সিটি, টু টাউন’ মডেলে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। বহুদিন ধরে টানেলের বিষয়টি আলোচিত হলেও এটি বাস্তবায়নের পর্যায় শুরু হয় ২০১৩ সালে। ওই সময় এক সমীক্ষায় দক্ষিণ চট্টগ্রামের উন্নয়ন, অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধির জন্য টানেল অর্থনৈতিকভাবে খুবই জরুরি ভূমিকা রাখবে বলে উল্লেখ করা হয়। ওই সমীক্ষায় বলা হয় যে, টানেলের ভিতর দিয়ে বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারবে। প্রতিদিন চলাচল করতে পারবে অন্তত সাড়ে ১৭ হাজার গাড়ি। ২০২৫ সাল নাগাদ টানেল দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন যাতায়াত করার কথাও সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়। কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণ প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়ার পর বিস্তারিতভাবে প্রজেক্ট প্রোফাইল তৈরি করা হয়। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ২০১৫ সালের নভেম্বরে ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা ব্যয়ে মাল্টি-লেন রোড টানেল প্রকল্পটি অনুমোদন করে। ওই সময় প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
বাংলাদেশ ও চীন সরকারের যৌথ অর্থায়নে টানেল প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। চীনের এক্সিম ব্যাংক ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে এবং বাকি অর্থ দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। চীনের এক্সিম ব্যাংক দুই শতাংশ হার সুদে এই ঋণ দিয়েছে।
শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের কারণে চট্টগ্রাম অঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাপকহারে বাড়বে। এর প্রভাব পড়বে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ছাড়াও পর্যটন নগর কক্সবাজার এবং পার্বত্য জেলা বান্দরবানের সেতুবন্ধন তৈরি করবে। জানা যায়, এই টানেল বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও জীবনমান উন্নয়ন, নগরায়ণ ও সমৃদ্ধির পথে যুক্ত করছে নতুন মাইলফলক। টানেলের কারণে চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক গুরুত্ব আরও বেড়ে যাবে। শুধু চট্টগ্রাম নয়, এই টানেলের কারণে বাংলাদেশও অনেক দূর এগিয়ে যাবে। মাতারবাড়ী সমুদ্র বন্দর থেকে সহজেই সারা দেশে পণ্য আনা-নেওয়া যাবে। টেকনাফ থেকে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল পর্যন্ত শিল্পায়নের বিপ্লব ঘটবে। বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। টানেলের কারণে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাও উন্নত হবে। টানেল এলাকার আশপাশের এলাকার জমি জমার মূল্য বৃদ্ধি ইতিমধ্যেই হয়েছে। বাংলাদেশের বড় বড় শিল্পপতিরা ব্যাবসার উদ্দেশ্যে আশপাশে জমিজমা কিনতে শুরু করেছে। টানেলকে ঘিরে ওই এলাকায় জমির ক্রয় বিক্রয় চলছে। স্থানীয় এলাকা সহ পুরো চট্টগ্রামের জনগণ টানেলটি উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে। পুরো চট্টগ্রামবাসী খুবই খুশি। টানেলের নিরাপত্তার জন্য আইন শৃংখলা বাহিনী সর্বদা প্রস্তুত আছে।
সম্ভাবনাময় দীর্ঘমেয়াদী এই টানেলটি যেনো সুন্দর সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়। টানেলকে ঘিরে যে সকল রাস্তা নির্মিত হয়েছে সেগুলোকেও যেনো যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখা হয়। কর্ণফূলীর পর আনোয়ারা ও বাঁশখালী উপজেলার যান চলাচলের রাস্তা এখনো সেই পুরনো ভাবে রাখা হয়েছে। কক্সবাজারের যাতায়াতের জন্য আনোয়ারা বাঁশখালী উপজেলাকে রাস্তা হিসেবে ব্যবহার করছে শত শত যানবাহন ও হাজার হাজার মানুষ। আনোয়ারা উপজেলাতে রাস্তাগুলো প্রশস্ত করা হয়েছে। এখনো কোনো কোনা রাস্তার উন্নয়ন কাজ অব্যাহত আছে। বাঁশখালী উপজেলার প্রধান সড়কটি এখনো প্রশস্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। টানেল চালু হলে অনেকগুলো গাড়ি আনোয়ারা বাঁশখালী উপজেলা হয়ে কক্সবাজারে প্রবেশ করবে। বাঁশখালীর প্রধান সড়ক প্রশস্ত না হওয়ায় প্রতিদিন সেই রাস্তায় দূর্ঘটনা হচ্ছে। জানমালের ক্ষতি হচ্ছে। রাস্তার দুপাশে বাজার ও অবৈধভাবে মার্কেট দোকান গড়ে উঠেছে। টানেলের উপকারীতা ভোগ করে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে যাতায়াতকারী পরিবহণগুলোকে নির্বিঘ্নে করতে হলে বাঁশখালী উপজেলার প্রধান সড়কটি প্রশস্ত করা জরুরি।
প্রধান সড়কের দুপাশের অবৈধ মার্কেট দোকান উচ্ছেদ করা দরকার। সেই রোডের চলাচলকারী গণপরিবহণগুলোকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে হবে। পরিবহণ মালিক শ্রমিক স্থানীয় প্রশাসনকে এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ চায় স্থানীয় জনগণ। চট্টগ্রামের আশা ও আকাঙ্খা প্রতিফলনের টানেলটি উদ্বোধনের অপেক্ষায় অধীর আগ্রহ দেখছে আনোয়ারাসহ দেশবাসী।