দেশের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় জমায়েত বিশ্ব ইজতেমা হলেও এর গোড়াপত্তন হয় ভারতে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে এটা অর্ধশতকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের টঙ্গীতে ধারাবাহিকভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এতে লাখ লাখ মানুষ অংশ নেয়, যাদের মধ্যে বিদেশিদের সংখ্যা উল্লেখ করার মতো। বাংলাদেশে তাবলিগে জামাতের গোড়াপত্তন ১৯৪৪ সালে। মহান কর্মবীর মাওলানা আব্দুল আজীজ (রহ.)-এর হাত ধরে। সেই থেকে প্রতি বছর বাংলাদেশে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সেই হিসাবে এ বছরের ইজতেমা ৭২তম। যদিও আনুষ্ঠানিক হিসাব মাত্রায় এবারের ইজতেমা ৫৩তম।
তাবলিগ জামাতের বার্ষিক সম্মেলন এই বিশ্ব ইজতেমা। পৃথিবীব্যাপী আগামী বছরের মেহনতের রোডম্যাপ গ্রহণ করা হয়। ইজতেমায় অংশ নেন প্রতিটি জনপদের মুরুব্বি ও দায়িত্বশীলগণ। বিগত বছরের কাজের পর্যালোচনা, আগামী বছরের পরিকল্পনা, সাথিদের মজবুত হওয়া, নিজ নিজ এলাকায় কাজ সৃষ্টি, দৈনিক দাওয়াত, সাপ্তাহিক গাসত, কিতাব তালিমসহ পাঁচ কাজ চালু করা ইত্যাদি বিশ্ব ইজতেমার কর্মসূচিতে থাকে। এছাড়াও খ্রিষ্টান প্রধান দেশগুলোতে দাওয়াতের পন্থা নির্ণয়, সম্ভাব্য যাচাই, কাজের ধরন, মেহনতের বিকল্প পন্থা ব্যবহারসহ আশা, পরিকল্পনা, বাস্তবায়নের চমত্কার সব ইশতেহার ঘোষিত হয় বিশ্ব ইজতেমার মেম্বার হতে। তুরাগতীরের এ ক্ষুদ্র স্থানটি আলোক বিভা ছড়িয়ে দেয় বিশ্বময়। মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) ১৯১০ সালে সাধারণ তুলনামূলক ধর্মীয় জ্ঞানশূন্য এমন মানুষদের দিনের ফরজিয়্যাত আমলে আনার দাওয়াত দেন। হজরত ইলিয়াস (রহ.) ছিলেন দেওবন্দের ছাত্র। জ্ঞানে গুণে ইলমে আমলে পরিপক্ব আলেম ছিলেন।
ভারতের সাহারানপুর অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় তাবলিগি কাজের বীজ অঙ্কুরিত হয়ে তা পত্র-পল্লবে ছড়িয়ে আজ বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত বিশাল মহিরুহ। বিশ্বে এমন কোনো দেশ হয় তো পাওয়া যাবে না, যেখানে মানুষ আছে, অথচ তাবলিগ আন্দোলনের কাজ নেই। তত্কালীন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী দিল্লির দক্ষিণ পার্শ্বস্থ এক নীরব অঞ্চল মেওয়াত। চারিত্রিক বিপর্যস্ত ধর্মকর্মহীন নামমাত্র মুসলমান জনগোষ্ঠীকে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস, ধর্মের পূর্ণাঙ্গ অনুশীলন ও কালেমার মর্ম শিক্ষা দান এবং গোমরাহির কবল থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে হজরতজি মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)-এর তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম শুরু করেন।
১৩৪৫ হিজরিতে হজ থেকে ফিরে এসে তিনি তাবলিগি গাসত শুরু করেন। জনসাধারণের মধ্যে দাওয়াত দিতে লাগলেন কালেমা ও নামাজের। লোকজনকে তাবলিগ জামাত বানিয়ে বিভিন্ন এলাকায় বের হওয়ার দাওয়াত দিলেন। ইতিহাসে পাওয়া যায়, হজরত ইলিয়াস (রহ.) যখন মানুষের কাছে ধর্মীয় প্রচার শুরু করেন, তখন তেমন কোনো সাড়া মেলেনি। তাই তিনি অভিনব এক কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি আশপাশের দিনমজুর শ্রমিক কৃষকদের ডেকে এনে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত রেখে দুই বেলা খাবার দিতেন নিজ খরচে। এবং তাদেরকে নামাজ শিক্ষা দিতেন, নামাজের সুরা শেখাতেন, ধর্মীয় বিধি-নিষেধ বর্ণনা করতেন। অবশেষে বিদায়বেলা তাদের প্রত্যেককে মজুরি তথা পারিশ্রমিক দিয়ে দিতেন। পদ্ধতি অত্যন্ত ফলপ্রসূ হলো। অল্প সময়ের ব্যবধানেই তার নামাজের আন্দোলনের সদস্যসংখ্যা উল্লেখযোগ্য হয়ে পড়ল। জনগণ নিজেরাই নিজ অর্থ ব্যয় করে ইলিয়াস (রহ.)-এর পদাঙ্ক অনুকরণ করে দাওয়াতি কার্যক্রম চালাতে থাকেন। আজ ইজতেমায় অংশগ্রহণ করে বিশ্বের দেড়শতাধিক দেশের জনগণ। টঙ্গির শিল্পনগরীতে স্থায়ীভাবে ইজতেমা স্থানান্তরিত করা হয় ১৯৬৬ সালে, আর সে বছর থেকেই তাবলিগ জামাতের এই মহাসম্মেলন ‘বিশ্ব ইজতেমার’ নামে খ্যাতি অর্জন করে। এই ইজতেমা এখন মুসলিম ঐক্যের এক অপূর্ব মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। এ যে ইমানের মিলনমেলা, দিন শিক্ষার কেন্দ্র, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা ও পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কো. লি.