জানা গেছে, অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের ব্যবসা খুলে বৈদেশিক মুদ্রা কেনাবেচা করছে শতাধিক প্রতিষ্ঠান।সম্প্রতি বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে এমন তালিকা পাওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
সিআইডি সুত্রমতে, অবৈধ এসব মানি এক্সচেঞ্জের পেছনে রয়েছেন অনেক রাঘববোয়াল। যাদের রয়েছে রাজনীতিক, সামাজিক ও ব্যবসায়ী পরিচয়।
ব্যাংক ও সিআইডির তথ্যমতে, সারা দেশে অন্তত ১ হাজার অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান রয়েছে তন্মধ্যে শুধু চট্টগ্রামে আছে শতাধিক। যারা ডলার কেনাবেচার আড়ালে অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত। সারা দেশে বৈধ-অবৈধ প্রতিষ্ঠানের বাইরেও ভ্রাম্যমাণ কিছু ব্যবসায়ী রয়েছে, যারা ফোনে যোগাযোগ করে হোম ডেলিভারিতেও বেচাকেনা করছে দেশি-বিদেশি মুদ্রা।
জানা গেছে, সারাদেশে ২৩৫টি বৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
দেশে ডলার সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে ১৭ জানুয়ারী মঙ্গলবার রাজধানীর পাঁচ স্থানে একযোগে অভিযান পরিচালনা করে সিআইডি। এর মধ্যে তিনটি অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ অফিস হলো গুলশানের জে এম সি এইচ প্রাইভেট লিমিটেড, মোহাম্মদপুরের টোকিও স্কয়ারের আলম অ্যান্ড ব্রাদার্স এবং উত্তরার আশকোনা মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের তৈমুর মানি এক্সচেঞ্জ। বাকি দুটি ফেরারি প্রতিষ্ঠান।কিন্তু চট্টগ্রামের কোথাও এই ধরণের অভিযান পরিচালনার খবর পাওয়া যায়নি।চট্টগ্রামের লালদীঘির পূর্বপাড়, চকবাজার, বহদ্দারহাট, কোতোয়ালীর মোড় ও আগ্রাবাদে বেশ কয়েকটি অবৈধ মানি একচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
এই পাঁচ প্রতিষ্ঠান থেকে ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১৯টি দেশের ১ কোটি ১১ লাখ ১৯ হাজার টাকা সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রাসহ ১ কোটি ৯৯ লাখ ৬১ হাজার ৩৭৬ টাকা জব্দ করা হয়।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন আবু তালহা ওরফে তাহারত ইসলাম তোহা (৩২), আছাদুল শেখ (৩২), হাছান মোল্যা (১৯), আব্দুল কুদ্দুস (২৪), হাসনাত এ চৌধুরী (৪৬), শামসুল হুদা চৌধুরী ওরফে রিপন (৪০), সুমন মিয়া (৩০), তপন কুমার দাস (৪৫), আব্দুল কুদ্দুস (৩২), কামরুজ্জামান রাসেল (৩৭), মনিরুজ্জামান (৪০), নেওয়াজ বিশ্বাস, আবুল হাসনাত (৪০) ও শাহজাহান সরকার (৪৫)।
১৮ জানুয়ারী বুধবার দুপুরে সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে সিআইডির প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ আলী মিয়া সংবাদ সম্মেলন করে এসব তথ্য জানিয়েছেন ।
এই সময় সিআইডি প্রধান বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা স্বীকার করেছে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান দিনে গড়ে প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টাকা সমমূল্যের বিদেশি মুদ্রা অবৈধভাবে ক্রয়-বিক্রয় করে।
অভিযানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সিআইডির পদস্থ এক কর্মকর্তা বলেন, গুলশান এলাকায় এমনও অবৈধ প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে কয়েক কোটি টাকার ডলার ক্রয়-বিক্রয় হয়। আমাদের কাছে যে তালিকা রয়েছে, তা ধরে হিসাব করলে আনুমানিক ৭০০ কোটি টাকার মতো অবৈধভাবে এক্সচেঞ্জ হয় এবং এটি প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
কেন অবৈধভাবে মানি এক্সচেঞ্জ বাড়ছে—এমন প্রশ্নের জবাবে সিআইডি প্রধান বলেন, খুব অল্প সময়ে লাভবান হওয়া যায়, তাই অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সোর্স ও সিআইডির সোর্সের মাধ্যমে আমরা অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের বিরুদ্ধে অভিযান করছি।
অবৈধভাবে মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকের জ্ঞাতসারেই হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর কোনো গাফিলতি রয়েছে কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মাদ আলী মিয়া বলেন, দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে কোনো অবৈধ পথ বেছে নেওয়া উচিত হবে না কারও। বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্য যে কোনো ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তার যদি হুন্ডি কিংবা অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের সঙ্গে জড়ানোর তথ্য মেলে, তবে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। দেশের মানুষকে অনুরোধ করব, সরকার ঘোষিত এবং সংশ্লিষ্ট বৈধ ব্যাংক থেকে ডলার ক্রয়-বিক্রয় করতে।
সারা দেশে অন্তত ১ হাজার অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা ডলার কেনাবেচার আড়ালে অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত। বৈধ-অবৈধ প্রতিষ্ঠানের বাইরেও ভ্রাম্যমাণ কিছু ব্যবসায়ী রয়েছে, যারা ফোনে যোগাযোগ করে হোম ডেলিভারিতে বেচাকেনা করছে দেশি-বিদেশি মুদ্রা।
এদিকে, মানি একচেঞ্জের লাইসেন্স দেওয়া দেড় যুগ ধরে বন্ধ রয়েছে। যার ফলে বেড়েছে অবৈধ বিনিময়ের হার। আর এতে বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভ হারাচ্ছে সরকার।
জনশক্তি রফতানি ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বাড়লেও তুলনামূলক ভাবে নতুন কোনো মানি একচেঞ্জের অনুমোদন দেওয়া হয়নি।ব্যবসায়ীরা জানান, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় মূল্য ব্যাংকের চেয়ে বাইরে বেশি পাওয়ায় গ্রাহকরা অবৈধ প্রতিষ্ঠানের দিকেই ঝুঁকেছেন। তাই অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে লেনদেন বেশি হয়।১৯৯৮ সালের পর থেকে দেশে নতুন মানি একচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তেমনি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ব্যবসা করায় নিবন্ধন বাতিলের ফলে ১৮ বছরে লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে চার শতাধিক প্রতিষ্ঠানের। বর্তমানে দেশে দুইশতাধিক প্রতিষ্ঠান মানি একচঞ্জের ব্যবসা করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এসব মানি একচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোতে অবৈধ লেনদেন হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার আলোকে কোনো গ্রাহকের অনুকুলে এক হাজারের বেশি ডলার বিনিময় করার সুযোগ নেই। আর এক হাজার ডলার লেনদেন করার জন্য গ্রাহকের পাসপোর্টসহ মানি একচেঞ্জ হাউজে যেতে হয়। এক্ষেত্রে ৯০ শতাংশ গ্রাহক ডলার ক্রয়-বিক্রয় করতে পাসপোর্ট নিয়ে যান না। তাই লেনদেন চলছে হিসাবের বাইরে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, ১৯৯৯ থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬১ শতাংশ মানি এক্সচেঞ্জের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশে বর্তমানে অনুমোদিত মানি এক্সচেঞ্জের সংখ্যা ২৩৫টিতে এসে ঠেকেছে। সর্বশেষ বাতিল করা হয়েছে এজে মানি এক্সচেঞ্জের নিবন্ধন। বাতিল হওয়া এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই আবার হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, প্রতিষ্ঠানগুলো লেনদেনের সঠিক হিসাব সংরক্ষণ করে না। যখন হিসাবের বিবরণ সংরক্ষণের নির্দেশ দেওয়া হয় তখন তারা প্রতিদিনের লেনদেন হিসেব যৎসামান্য উল্লেখ করেন। কিন্তু পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেছে ড্রয়ার ভর্তি ডলার। অনুমোদন ছাড়াই ঢাকা ও ঢাকার বাইরে শাখা স্থাপন করেছে।
এবিষয়ে মানি চেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি মোস্তফা খান বলেন, ‘মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা প্রায় ধংসের মুখে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম মেনে একজন গ্রাহকের কাছে ভিসা ছাড়া মাত্র ২০০ ডলার বিনিময় করতে পারে। আর ভিসার বিপরীতে বিনিময় করা যায় সর্বোচ্চ এক হাজার ডলার। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে অনেক সহযোগিতা চেয়েছি। তারা আমাদের অনুরোধ আমলেই নেন না। ’
মোস্তফা খান আরো বলেন, ‘কিছু মানি একচেঞ্জ অবৈধভাবে ব্যবসা করছে, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থাও নিচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অনেক মানি এক্সচেঞ্জের মূল মালিক এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন না। নাম ভাঙিয়ে অন্য একটা গোষ্ঠী এসব প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগাচ্ছে।
তবে এখতিয়ার না থাকায় অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রশাসনের সহযোগিতায় দুই-একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে উচ্ছেদ করা গেলেও এখনো অনেক ভুয়া প্রতিষ্ঠান বাজারে রয়েছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
২০১৫ সালে মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের সব হিসাব অনলাইনে করার নির্দেশনা দিয়েছিলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোর আপত্তিতে সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে অর্থপাচার রোধে এসব প্রতিষ্ঠানকে রিপোর্ট প্রদানকারী সংস্থা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
’