ঢাকা অফিস
আওয়ামী লীগের কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে কি আওয়ামী লীগের পঞ্চপাণ্ডব যুগের অবসান ঘটলো? কাউন্সিলের পর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে এই প্রশ্নটি বড় হয়ে সামনে এসেছে। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের গত কাউন্সিলের পর সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর পরপরই দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হয়। করোনা সংক্রমণ শুরু হলে অসুস্থ ওবায়দুল কাদের ঘরেই নিজেকে বন্দী করে রাখেন এবং ঘরে থেকেই তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। এই অবস্থায় দল পরিচালনা, দলের বিভিন্ন সাংগঠনিক বিষয় দেখভাল করা এবং সমস্যা সমাধান করার দায়িত্ব পরে দলের শীর্ষ পাঁচ নেতার ওপর।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রহমান, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম এবং এস এম কামালের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে পঞ্চপাণ্ডব। যারা দলের মূল সাংগঠনিক বিষয়ে দেখভাল শুরু করেন এবং দলের তৃণমূলের সাথে সরাসরি যোগসূত্র হয়ে ওঠেন। ফলে দলের সাংগঠনিক বিষয়ে তাদের ক্ষমতার প্রভাব বৃদ্ধি পায়। অনেক বিষয়ে তারাই হয়ে ওঠেন নীতিনির্ধারক এবং কোনো কোনো বিষয়ে দলের সাধারণ সম্পাদকের বদলে তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সভাপতিও সাংগঠনিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের ওপরই আস্থাশীল হয়েছিলেন।
কিন্তু এবারের কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে পঞ্চপাণ্ডব যুগের অবসান ঘটলো বলেও অনেকে মনে করছেন। এই পঞ্চপাণ্ডবের বদলে ড. হাছান মাহমুদ, ডা. দীপু মনিকে ক্ষমতাবান করা হয়েছে। এর ফলে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণে পঞ্চপা-বের ক্ষমতা হ্রাস করা হলো বলেও কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করছেন। বিশেষ করে, ওবায়দুল কাদের কাউন্সিলের আগে যেভাবে তৎপর ছিলেন, বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন, বিভিন্ন সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন তার যদি সিকিভাগও তিনি এখনও অব্যাহত রাখেন, তাহলেই আওয়ামী লীগের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে তিনিই বিবেচিত হবেন। সেক্ষেত্রে প্রেসিডিয়ামের দুই সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং আব্দুর রহমানের ভূমিকা সংকোচিত হতে বাধ্য। তাছাড়া, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ডা. দীপু মনি দু’টি কমিটিতেই (অর্থাৎ সংসদীয় মনোনয়ন কমিটি এবং স্থানীয় সরকার মনোনয়ন কমিটি) থাকার ফলে তিনি এখন দলের অন্যতম নীতিনির্ধারকে পরিণত হলেন। এছাড়া ড. হাছান মাহমুদকে ১ নম্বর যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক করায় মাহবুবউল হানিফের কর্তৃত্ব দলের ভেতর কমে গেলো এবং বাহাউদ্দিন নাছিমের অবস্থানও নিচে নেমে গেলো। এর প্রেক্ষিতে যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বাহাউদ্দিন নাছিমের ক্ষমতাও হ্রাস পেলো বলে অনেকেই মনে করছেন। তাছাড়া দুইজন সাংগঠনিক সম্পাদক আগে যেভাবে দলের দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং আব্দুর রহমানের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন, দলের সাধারণ সম্পাদক অনেক বেশি কার্যকর হওয়ার ফলে তাদের ওপর সাংগঠনিক সম্পাদকদের নির্ভরতা কমে যাবে। যে কোনো সিদ্ধান্তের জন্য, তারা এখন দলের সাধারণ সম্পাদকের দিকেই তাকিয়ে থাকবেন।
এর ফলে, পঞ্চপাণ্ডবদের যে মেরুকরণ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে হয়েছিল, তা ভেঙ্গে যেতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন। এবারের কাউন্সিলে একক নেতৃত্ব এবং রদবদলের যে ধারা দেখা গেছে তাতে সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগের পঞ্চপাণ্ডবের ভূমিকা কিছুটা হলেও হ্রাস পাবে। তাছাড়া, সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে সুজিত নন্দীর স্থান পাওয়ার ফলে অন্য দুই সাংগঠনিক সম্পাদকের প্রভাব কমবে কি না, সেটিও এখন দেখার বিষয়। সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগের এবারের কাউন্সিলে যৌথ নেতৃত্ব নয়, বরং একক নেতৃত্বের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে রাজনীতিতে শেষ কথা হলো, কে কতটুকু পরিশ্রম করতে পারে এবং দলের জন্য কে কতটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে পারে। কর্মীদের জন্য কে কতটা বিশ্বস্ত, এটি একজন রাজনৈতিক নেতার জনপ্রিয়তার মাপকাঠি। সে হিসেবে এবার কাউন্সিলে পঞ্চপাণ্ডবকে আপাত কোণঠাসা মনে হলেও শেষ পর্যন্ত পঞ্চপাণ্ডবরাই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে মূলধারা হবে কি না, সেটিই এখন দেখার বিষয়।