মো. আবদুর রহিম
পৃথিবীর কোনো কিছুই এক তরফা নয়, সবকিছুই তুলনামূলক। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তুলনা চলে বিগত দিনের রাষ্ট্র ব্যবস্থা আর বিগত ১৪ বছরের রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়ে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সময়ে কেমন ছিল বাংলাদেশ, ২০০১ থেকে ২০০৬ এর বাংলাদেশের ইতিহাস কি ? ২০০৭-২০০৮ এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাজ কি ছিল ? ২০০৯ থেকে ২০২২ কেমন বাংলাদেশ ? জিয়াউর রহমানের শাসনকাল হত্যা, ক্যু আর ষড়যন্ত্রের সময়। তাঁর সময়ে মুক্তিযোদ্ধা হত্যা, সেনানিবাসে নির্বিচারে হত্যা। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্মৃতিচিহ্ন ধ্বংস, জাতির পিতা, জয় বাংলা নির্বাসনে পাঠানো আর গোলাম আযমের উত্থান, যুদ্ধে পরাজিত রাজাকার প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী বানানো এবং দেশটির শহীদের রক্তের সাথে প্রতারণা করে রাষ্ট্রযন্ত্র দখলে নিয়ে ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’ নীতি, হোন্ডা, গুন্ডা, বিনোদন আর দখলের রাজত্ব কায়েম।
এরশাদের রাজনীতিও একই ধারায়। তার সাথে যুক্ত সন্ত্রাস, ইমদু কাহিনী, গণতন্ত্র, ভোট ও ভাতের অধিকার হরণ। জাতীয় নেতা হত্যা, গুম করা ছিল এদের রাজনীতি। সামরিক শাসনের গর্ভে বিলিন হয় গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার। এই দুই সামরিক শাসকদের ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত সময় ছিল খুনী, যুদ্ধাপরাধি, সন্ত্রাসী, গুন্ডা, পাণ্ডাদের দৌরাত্ম। গণতন্ত্র আইনের শাসন, মানবাধিকার, সুশাসন ছিল কল্পনার জগতে। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ এ সময়ে দেশের মানুষ ছিল জিম্মি। দেশের পাহাড়-পর্বত-সমতল সর্বত্র ছিল তাণ্ডব, ভয়াবহ তাণ্ডব , লুটপাট, জামাত-স্বাধীনতা বিরোধী, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার খুনীদের দাপটে, গণতন্ত্র, ন্যায় বিচার ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। ২০০১ থেকে ২০০৬ সময়ে কোটি ভূয়া ভোটার তালিকায় অর্ন্তভুক্ত করা, নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করা, ভোটারবিহীন নির্বাচন করা, বিরোধী রাজনৈতিক দল তথা আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব শূণ্য করা, শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা, জনপ্রিয় মন্ত্রী, এমপি বিশেষ করে ময়েজ উদ্দিন, এ এস এম কিবরিয়া, আহসান উল্লাহ মাস্টার, শামসুর রহমান, মুকুল, মঞ্জুরুল ইমাম, মানিক সাহা, হুমায়ুন কবীর বালু সহ আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতা-কর্মী হত্যা, ধর্ষণ, গুম, ব্যবসা বাণিজ্য দখল ইত্যাদি কু-কর্মের সাথে ছিল জঙ্গী হামলা। একই সময়ে ৬৩ জেলায় বোমা হামলা, অবৈধ অস্ত্র আমদানী, দেশের অর্থ পাচার, দখল, টেন্ডারবাজি ইত্যাদি। মোট কথায় জিয়া, এরশাদ, খালেদার শাসন আমল ছিল দেশ ও জাতির এক কঠিন দুঃসময়। হাওয়া ভবন, খোয়াব ভবন, গণভবন ইত্যাদি ভবনের লোমহর্ষক কাহিনীতে দেশ ও জাতি ছিল অতিষ্ট। গণতন্ত্র, ভোট ও ভাতের অধিকার ছিল উপেক্ষিত। তবে গত ১৪ বছরে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশের জন্য প্যারাডাইস শিফটের মতো বহু অর্জন হয়েছে। স্বল্প উন্নত দেশের গ্লানি থেকে মধ্য আয়ের উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠেছে বাংলাদেশ। যার অফিশিয়াল স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক সংস্থা। দ্বিতীয় আরেকটি প্যারাডাইস শিফটের মতো অর্জন হচ্ছে সেই ১৯৪৭ সাল থেকে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে জিইয়ে থাকা সমুদ্র সীমানার দ্বন্দ্ব শান্তিপূর্ণ পন্থায় মীমাংসা হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকার একচ্ছত্র মালিকানা পেয়েছে। অফুরন্ত সমুদ্র সম্পদের যথার্থ ব্যবহার করা গেলে বাংলাদেশকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। এ বঙ্গ-ইকোনমি ঘিরে শেখ হাসিনা গ্রহণ করেছেন ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ দেশ স্বাধীনতার পর থেকে করিডোর বা ছিটমহলবাসী স্বাধীনতা ভোগ করতে পারেনি। বাংলাদেশ ও ভারতের ছিটমহল সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়েছে ছিটমহলের। নাগরিক শ্রেণি পেয়েছে স্বাধীনতা, উন্নয়ন ও মৌলিক অধিকার। ছিটমহল সমস্যার সমাধানও জননেত্রী শেখ হাসিনার অবদান। নদী মাতৃক বাংলাদেশটির ৫৩টি নদী ভারতের সাথে সংযুক্ত। নদী সমূহের পানির ন্যায্য হিস্যার বিষয়টিও মিমাংসা এসেছে বঙ্গবন্ধু কন্যার হাত ধরে। তিস্তা নদীর চুক্তি বাস্তবায়নে কিছুটা সমস্যা রয়ে গেছে তা শীঘ্রই মিমাংসা হবে এমনটাই আশা দেশবাসীর। এছাড়াও অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতের উন্নয়ন পরিমাপের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃত যতগুলো সূচক রয়েছে তার প্রায় সবকটিতে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। সফল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি সরাসরি জনতার মুখোমুখি হচ্ছেন। গত ২৪ নভেম্বর ২০২২ খ্রি. প্রথম একটি জনসমুদ্রে উপস্থিত হন জননেত্রী শেখ হাসিনা। যশোহরের স্টেডিয়ামে তিনি বলেছেন, ‘না চাইলে আমি দেব’। বদলে দেবেন মানুষের ভাগ্য।
৪ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু কন্যা আসছেন প্রাচ্যের রানী খ্যাত চট্টগ্রামে। তিনি পলোগ্রাউন্ডের বিশাল জনসভায় কথা বলবেন চট্টগ্রামবাসীর সাথে। বঙ্গবন্ধু কন্যা সফল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে ঐতিহাসিক লালদীঘির মাঠের বিশাল জনসমুদ্রে তিনি বলেছেন, ‘চট্টগ্রামের উন্নয়নের দায়িত্ব আমি নিজ হাতে নিলাম’। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা চট্টগ্রামবাসীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে পিছপা হননি। প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামের উন্নয়নে বহুমাত্রিক উদ্যোগ নিয়েছেন। জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগা প্রকল্প, ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, আউটার রিংরোড, বঙ্গবন্ধু টানেল, দোহাজারী-কক্সবাজার রেল লাইন, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর, কোরিয়ান ইপিজেড, চায়না ইকোনমিক জোন, মহেশখালীর ইকোনমিক জোন, মহেশখালী এলএনজি টারমিনাল, গভীর সমুদ্র বন্দর, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, বাঁশখালীতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে উন্নীতকরণ, চট্টগ্রাম কক্সবাজার সড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ, চট্টগ্রাম বন্দর বে-টার্মিনাল নির্মাণ, বুলেট ট্রেন বাস্তবায়ন প্রকল্প সরকারের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে। যার মাধ্যমে মাত্র এক ঘন্টায় ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াত করা সম্ভব। বঙ্গবন্ধু কন্যা চট্টগ্রামের প্রতি এতটাই আন্তরিক যে, তিনি মিরসরাই বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর থেকে সৈকত ঘেঁষা মেরিন ড্রাইভ কক্সবাজার পর্যন্ত বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। প্রায় ১৬৮ কিলোমিটার দীর্ঘ পৃথিবীর দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভটি চট্টগ্রামের মিরসরাই জোরারগঞ্জ থেকে কক্সবাজারের শহরতলী পর্যন্ত নির্মিত হবে। মিরসরাই জোরারগঞ্জ থেকে চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা কর্ণফুলী টানেলের মুখ পর্যন্ত ৬ লেন এবং টানেলের আনোয়ারা প্রান্ত থেকে কক্সবাজার শহরতলী পর্যন্ত হচ্ছে চার লেন। এ প্রকল্পের সম্ভাব খরচ হবে প্রায় ৩.৭ মিলিয়ন ইউএস ডলার। অপরদিকে ঢাকার পর জাতীয় অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রামেও মেট্রোরেল নির্মাণের উদ্যোগ চট্টগ্রামের আরো একটি স্বপ্নপূরণ। ট্রান্সপোর্ট মাস্টার প্ল্যান অ্যান্ড প্রিলিমিনারি ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি ফর আরবান মেট্রোরেল ট্রানজিট কন্সট্রাকশন অব চিটাগাং মেট্রোপলিটন এরিয়া’ শীর্ষক এ প্রকল্পের সমীক্ষা ব্যয় হবে ৭০ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রাম মহানগরীর যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো গতিময় হবে। ঢাকা ট্রান্সপোর্ট অর্ডিনেশান অথরিটি (ডিটিসিএ) মেট্রোরেলের সমীক্ষা চালাবে। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সিংহভাগ অর্থ বিনিয়োগ করবে দক্ষিণ কোরিয়া। ৭০ দশমিক ৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে এ সমীক্ষা প্রকল্পের ৫১ কোটি টাকা সহায়তা দেবে কোরিয়া ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি। বাকী ১৩ কোটি ৬৩ লাখ টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার। ২০২৫ সালের মার্চের মধ্যে সমীক্ষার কাজ শেষ করার কথা রয়েছে। মেট্রোরেল, মেরিন ড্রাইভ, বুলেট ট্রেন, কালুরঘাট ব্রিজ ও বন্দরের বে-টার্মিনাল ঘিরে চট্টগ্রামের উন্নয়ন স্বপ্ন বাস্তবায়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গভীর আন্তরিকতার প্রকাশ।বঙ্গবন্ধুর তনয়া চট্টগ্রাম নিয়ে তাঁর যেসব পরিকল্পনা তা বাস্তবায়নে দরকার সরকারের ধারাবাহিকতা।
বীর চট্টগ্রামবাসী ৪ ডিসেম্বর ২০২২ খ্রি. তারিখের নির্ধারিত জনসভাকে জনসমুদ্রে পরিণত করে বঙ্গবন্ধু কন্যার আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন করবেন-এমনটাই আশা সকলের।