৫ দফা দাবী বাস্তবায়নে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড, চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলার উদ্যোগে ২৯ অক্টোবর শনিবার সকাল ১০টা হতে নগরীর জামালখানে ‘গুডস হিলের’ মূল প্রবেশপথ অবরুদ্ধ করে এক বিক্ষোভ সমাবেশ ও কুখ্যাত রাজাকার সাকা চৌধুরী বাসভবন ঘেরাও কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনের চট্টগ্রাম মহানগরের আহবায়ক সাহেদ মুরাদ সাকু’র সভাপতিত্বে এবং বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও চবি’র শিক্ষক ড. ওমর ফারুক রাসেল ও জেলার সদস্য সচিব কামরুল হুদা পাভেলের সঞ্চালনায় সমাবেশে ৫ দফা দাবী উত্থাপন করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি মোহাম্মদ সরওয়ার আলাম চৌধুরী মনি। দাবীগুলো হলো- ১) যুদ্ধাপরাধীদের সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের রাজনীতি ও নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা, ২) দÐিত যুদ্ধাপরাধীদের সকল সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা, ৩) মুক্তিযুদ্ধে নিরস্ত্র বাঙালিদের নির্যাতনের জন্য রাজাকার-আলবদর, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গড়ে তোলা সকল ‘টর্চার ক্যাম্পকে’ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর হিসেবে গড়ে তোলা, ৪) জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যায়ে সকল যুদ্ধাপরাধীর তালিকা করে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা এবং ৫) হুম্মামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের ও গ্রেফতার। বিক্ষোভ সমাবেশে যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর চট্টগ্রাম শহরের বাড়ির দেয়ালে ‘রাজাকারের বাড়ি’ লিখে দিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা। সেই বাড়িটি যে পাহাড়ে, সেই গুডস হিলকে ‘রাজাকার হিল’ লিখে টানিয়ে দেয়া হয়েছে ব্যানার। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিকামী নিরস্ত্র বাঙালিদের ধরে নিয়ে হত্যা-নির্যাতনের জন্য গড়ে তোলা সেই ‘টর্চার ক্যাম্প’ গুডস হিলকে বাজেয়াপ্ত করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর করারও দাবি জানিয়েছেন তারা। একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধে ফাঁসি হওয়া সাকা চৌধুরীকে ‘শহিদ’ উল্লেখ করে তার ছেলে বিএনপি নেতা হুম্মাম চৌধুরীর বক্তব্যের প্রতিবাদে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ সমাবেশে বীর মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা একাত্মতা প্রকাশ করে বক্তব্য দেন।
হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে প্রায় চারঘণ্টা ধরে চলা সমাবেশ থেকে যুদ্ধাপরাধীর সন্তান হুম্মাম কাদের চৌধুরীকে বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম মহানগর ইউনিট কমান্ডার মোজাফফর আহমেদ বলেন, ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের সন্তানদের রাজনীতিতে দেখতে চাই না, রাজাকারের সন্তানদের নির্বাচনে দেখতে চাই না। রাজাকারের বাড়িঘর, সম্পত্তি অবিলম্বে বাজেয়াপ্ত করা হোক। এজন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করতে আমরা সরকারকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দিচ্ছি। আগেভাগে বলে দিচ্ছি, সরকার যদি আমাদের দাবি প্রতি কর্ণপাত না করে তাহলে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামব।
সমাবেশে সাকা চৌধুরীর মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলার অন্যতম সাক্ষী গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা কাজী নুরুল আবসার বলেন, ‘একাত্তর সালে কুখ্যাত রাজাকার ফজলুল কাদের চৌধুরী আর তার কুলাঙ্গার ছেলে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, ফটিকছড়িতে যখন তাÐব চালাচ্ছিল, সেখানকার মানুষ যখন অকথ্য নির্যাতনের শিকার হচ্ছিল, তখন আমি এই শহরে চন্দনপুরায় গলির মুখে সালাহউদ্দিনের গাড়িতে আক্রমণ করেছিলাম। আমাদের কাছে খবর ছিল, সালাহউদ্দিন কাদের ড্রাইভিং সীটে থাকবেন। সেজন্য ড্রাইভিং সীট লক্ষ্য করে আক্রমণ করেছিলাম। কিন্তু সে ওই সীটে ছিল না, তবে আহত হয়েছিল। গাড়িচালক মারা গিয়েছিল।’ ‘আমি এখানে কোনো দলের নেতা হিসেবে বক্তব্য দিতে আসিনি, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এসেছি। সেদিন যেমন সালাহউদ্দিন কাদেরকে কেউ প্রতিরোধ করতে পারছিল না, আমিসহ কয়েকজন এই শহরে আক্রমণ করেছিলাম, তেমনিভাবে মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পর কেউ সাক্ষ্য দিচ্ছিল না, আমি গিয়ে সাক্ষ্য দিয়েছি। নিজের জীবনের নিরাপত্তা, পরিবারের নিরাপত্তা তুচ্ছ করে আমি সাক্ষ্য দিয়েছিলাম।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা নঈম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘রাজাকারের ছেলে হুম্মাম কাদের যে বক্তব্য দিয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের শহিদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে, এটা ধৃষ্টতাপূর্ণ রাষ্ট্রদ্রোহমূলক বক্তব্য বলে আমি মনে করি। তার বিরুদ্ধে অবিলম্বে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাচ্ছি। আমরা যারা মুক্তিযোদ্ধা আছি, আমাদের বয়স হয়ে গেছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস, আমাদের সন্তানরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবে।’
রাউজান উপজেলা চেয়ারম্যান এহছানুল হায়দার চৌধুরী বাবুল বলেন, ‘কীসের গুডস হিল, আজ থেকে এটা রাজাকার হিল। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানরা এটাকে রাজাকার বাড়ি লিখে দিয়েছে। হুম্মাম কাদের, কুলাঙ্গারের ঘরে কুলাঙ্গার জন্ম নিয়েছে।’
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক মশিউর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘হুম্মাম কাদের যুদ্ধাপরাধীর সন্তান। চট্টগ্রামের মাটি সূর্যসেন, প্রীতিলতা, এম এ আজিজ, জহুর আহমেদ চৌধুরী, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর মাটি। চট্টগ্রামের মাটি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মাটি। রাজাকারের ছেলে হুম্মাম যুদ্ধাপরাধীদের শহিদ বলার, জামায়াতের ¯েøাগান দেয়ার ধৃষ্ঠতা কোথায় পেয়েছে? শেখ হাসিনা যুদ্ধারপাধীদের বিচারের কথা দিয়ে কথা রেখেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলমান আছে। যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীও অনেক বড় বড় কথা বলত- কিন্তু আইনে তার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।
সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম মহানগর ইউনিট কমান্ডার মোজাফফর আহমেদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা নইম উদ্দিন নইম উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এ.কে.এম এহসানুল হায়দার চৌধুরী বাবুল, যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর মামলার অন্যতম সাক্ষী বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী নুরুল আবসার, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক মোঃ মশিউর রহমান চৌধুরী। সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম মহানগর ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল হক চৌধুরী সৈয়দ, আকবর শাহ থানার ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরউদ্দিন, চকবাজার থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোঃ শাহবুদ্দিন আহমেদ, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য জামশেদুল আলম চৌধুরী, চকবাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মোজাহেরুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক শায়দুল আজম শাকিল, চট্টগ্রাম মহানগর জাসদ সভাপতি জসিম উদ্দিন বাবুল, উদিচী চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপিকা শিলা দাসগুপ্ত, মহানগর যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহবায়ক মাহবুবুল হক সুমন, মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এম আর আজিম, কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপ্লব, কাউন্সিলর নূর মোস্তফা টিনু, কাউন্সিলর শৈবাল দাস সুমন, কাউন্সিলর শাহিনা আকতার রোজী, তরিকত ফেডারেশনের কাজী মোরশেদ কাদেরী, শরফুদ্দিন চৌধুরী রাজু, রাজিবুল হক সুমন, মেজবাহ উদ্দিন মোরশেদ, হাবিবুর রহমান তারেক, মোহাম্মদ ইলিয়াস, ইয়াছির আরাফাত, রাজীব হাসান রাজন, আবু সাইদ সুমন, নুরুল আজিম রনি, জাকারিয়া দস্তগীর, আমিনুল ইসলাম আজাদ, একরামুল হক রাসেল, ফারুক আহমেদ পাভেল, গোলাম সামদানী জনি, আমিতাভ চৌধুরী বাবু, খোরশেদ আলম মানিক, ইরফানুল আলম জিকু, কবির আহমদ, আবুল মনসুর টিটু, মাহমুদুল করিম, নাইম উদ্দিন, মিজানুর রহমান, রাকিবুল হাসান রাকিব, জাহেদুল ইসলাম, জিএম তৌসিফ, সুলতান মাহমুদ ফয়সাল, সাদ্দাম হোসেন ইভান, মুজিবুর রহমান রাসেল, মিজানুর রহমান সজীব, সাজ্জাদ হোসেন, ফয়সাল জামিল সাকী, কাজী রাজিশ ইমরান, সৈয়দ মাঈনুল আলম সৌরভ, আশরাফুল হক চৌধুরী, এস. এম. ইশতিয়াক রুমি, রিপন চৌধুরী, জয়নুদ্দিন আহমেদ, জয়নাল আবেদীন, নাইম হোসেন লিংকন, আব্দুল কাদের সবুজ, মোসাররফ হোসেন, রাজীব শিকদার জয়, শেখ ফরিদ মিঠু, আরমান উদ্দিন, নিলয় সকুল অনিক, কাওসার আহমেদ, খাজা মঈনুদ্দিন রিগান, আলী সরোয়ার মঞ্জু, শাকিল মাহমুদ জাকারিয়া, আবু ইবনু, মিশু শিকদার, মোঃ সেকান্দর হোসেন, রাকিব আয়ান, মোঃ রাসেল, শরিফুল হক নোবেল প্রমুখ।
বিক্ষোভ সমাবেশে বিভিন্ন থানা, উপজেলা ও ওয়ার্ড থেকে মিছিল নিয়ে ‘গুডস হিল ঘেরাও’ কর্মসূচিতে আসেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। সমাবেশ চলাকালেই মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা গুডস হিলের প্রবেশপথের দেয়ালে লিখে দেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নির্যাতন কেন্দ্র, রাজাকারের বাড়ি’। একইসঙ্গে গাছে টানিয়ে দেয়া হয়, ‘রাজাকার হিল’ লেখা ব্যানার। সমাবেশ মঞ্চের একপাশে যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর প্রতিকৃতি রেখে সেখানে ধিক্কার জানিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য লেখা হয়।