1. banglapostbd@gmail.com : admin :
  2. admin@purbobangla.net : purbobangla :
পদ্মা সেতু বদলে যাচ্ছে জীবন ধারা - পূর্ব বাংলা
সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০২:৩৭ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ
ক্ষমতার সামনে দাঁড়িয়ে সত্য বলার সাহস থাকাই হলো সাংবাদিকতা ক্ষমতার সামনে দাঁড়িয়ে সত্য বলার সাহস থাকাই হলো সাংবাদিকতা শহীদ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কবর জিয়ারত করলেন বিএনপি নেতা বিপ্লব মাওলানা শাহ সুফি মুহাম্মদ জামাল উদ্দিন মমিন (রঃ) এবং কবরবাসী স্বরণে ১ম বার্ষিক দোয়া মাহফিল ইউনেস্কো ক্লাব এর উদ্যোগে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন বায়েজিদ বোস্তামী ও মালেক শাহ (র.) ওরশ সম্পন্ন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ফোরকানিয়া মাদরাসা শিক্ষক সমিতির কার্যকরী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত  আল্লামা আবুল খাইর ফাউন্ডেশন ২৬৫ জন রোগীর ছানি অপারেশন করালেন আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ না হলে রাজপথ ছাড়বো না: হান্নান মাসউদ

পদ্মা সেতু বদলে যাচ্ছে জীবন ধারা

পূর্ব বাংলা ডেস্ক
  • প্রকাশিত সময়ঃ শনিবার, ২৩ জুলাই, ২০২২
  • ২০৮ বার পড়া হয়েছে

মীর নাসির উদ্দিন উজ্জ্বল (অতিথি প্রতিবেদক)

স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালুর মধ্য দিয়ে দুই প্রান্তের যুগান্তকারী নানা পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট। রাজধানীর সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার এ উন্নয়নের সঙ্গে শিল্প-বাণিজ্য ও পর্যটনের প্রসারের সম্ভাবনা প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু এমন সম্ভাবনার মধ্যেও দুশ্চিন্তায় পড়েছেন শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ঘাটকেন্দ্রিক কিছু কর্মজীবী। এরই মধ্যে বিকল্প কর্মসংস্থান বা পেশা বদল করেছেন অনেকে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার  কোটি কোটি মানুষের যাতায়াতের নতুন দিগন্ত উন্মোচন হয়েছে। দূর হয়েছে যুগ-যুগের ভোগান্তি। সেতু ঘিরেই ভাগ্যের দুয়ার খুলে গেছে। একটা সেতু ঘিরে এত বড় প্রভাব পড়তে পারে তা না দেখলে বিশ^াস করা যাবে না। যান বাহনের চাহিদাও বাড়ছে। তাই ঢাকা-মাওয়া রুটের ৩০০ বাসের ২৮০টিই চলছে পদ্মা সেতু অতিক্রম করে ঢাকা-ভাঙ্গাসহ দক্ষিণের বিভিন্ন  রুটে।

ঘাট দিয়ে হাজার হাজার লোক পারাপার হতো ঠিকই, কিন্তু অল্প সংখ্যক সাধারণ মানের ঘাটের টং হোটেলই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু পদ্মা সেতু ঘিরে লোকজনের আনাগোনা বাড়তেই পদ্মা তীরের রোস্তারাঁয় ইলিশের চাহিদা বাড়তে থাকল। প্রতিদিন টনে টনে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে। আর ছুটির দিনে এর পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে কয়েক গুণ। তাই ইলিশের রেস্তোরাঁ ব্যবসায় এক রকম বিপ্লব চলছে এখন।

এখানে ইলিশ আকৃতির ‘হিলশা প্রজেক্ট’ নামের রেস্তোরাঁ করে দেশব্যাপী ঝড় তুলেছে। প্রতিদিন নানা অঞ্চলের মানুষ সপরিবারে আসেন এই রেস্তোরাঁয় বসে রুপালি ইলিশের স্বাদ নিতে। আর রাজধানী ঢাকার লোকজন এখানে আসেন বেশি। বাদ যান না মন্ত্রী, এমপি, সচিবসহ বিশষ্টজনরাও। তাই ভিড় লেগেই আছে। প্রায় ২০ কোটি টাকা বিনিয়োগে এটি করা হয়েছে। এখন আরও ১০ কোটি টাকা বিনিয়োগ বাড়িয়ে এটি বর্ধিত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

পদ্মা সেতু মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটের রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ হয়ে যাবে বলে যে শঙ্কা অনেকে করছিলেন, তা মিথ্যা প্রমাণ হয়েছে এখন। সেসব দুঃশ্চিন্তাকে উড়িয়ে দিয়েছেন রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা। তাঁদের ভাষ্য, আমাদের কাস্টমার মূলত দর্শনার্থীরা, ঘাট দিয়ে পার হওয়া যাত্রীরা নয়। শিমুলিয়ায় এখন অর্ধশত রেস্তোরাঁ রয়েছে। এগুলোর অধিকাংশ ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে। এসব রেস্তোরাঁয় সহস্রাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। মালিক বা অংশীদারদের কেউ প্রবাসফেরত, কেউবা করোনাকালে ব্যবসা কিংবা কাজ হারিয়েছেন।

দেশের বৃহত্তম ও আধুনিক রেস্তোরাঁ হিলশা প্রজেক্ট ঘিরে চেহারা আরও বদলে দিয়েছে। গেল বছর চালু হওয়া এ রেস্তোরাঁয় একসঙ্গে এক হাজার লোক বসে খেতে পারে। এছাড়াও গত কয়েক মাসে বিলাশ বহুল বেশ কিছু রেস্তোরাঁ উঠেছে পদ্মা পারে। রেস্তোরাঁগুলোর নামও বেশ বাহারি। রূপসী বাংলা, রূপালি ইলিশ, শখের হাঁড়ি, কুটুম বাড়ি, শখের ইলিশ, ইলিশ আড্ডা ও ইলিশ ভোজ ইত্যাদি। ইলিশ ভোজ রেস্তোরাঁর মেসিয়ার আমিনুল ইসলাম বলেন, পদ্মা পারে মানুষ এসে সুখ পায়।

উত্তাল পদ্মা দেখা ছাড়াও প্রাণের পদ্মা সেতুর পুরো চেহারা দেখতে শিমুলিয়া ঘাটে আসে মানুষ। শিমুলিয়া ঘাট ছাড়া এত বড় সেতুর অধিকাংশ খুব একটা দেখা যায় না। তাই তারা নদী আর পদ্মা দেখে গরম গরম ইলিশের স্বাদ গ্রহণ করে। তাই সেতু চালুর পর দর্শনার্থীরা পদ্মা সেতু দেখতে এসে খাওয়া-দাওয়া করবে, মিনি কক্সবাজারের দেখবে, স্পিডবোট নিয়ে ঘুরে বেড়াবে। মনির হোসেন নামের আরেক মেসিয়ার বলেন, এখানে লোকজন ইলিশের যে স্বাদ পায় এটা অন্য কোথাও পায় না। তাই দল বেঁধে আছে। উৎসব উৎসব পরিবেশ থাকে ছুটির দিনগুলোতে। রাজধানীর গুলশান বাসিন্দা সামিয়া হোসেন এসেছেনে স্বামীর বাড়ি ও বাবা বাড়ির স্বজনদের নিয়ে। বড় টেবিলে বসে গরম গরম ইলিশ ভাজা খাচ্ছেন। সঙ্গে ইলিশের লেজ ভর্তা। আর ইলিশের টিম খাচ্ছেন আরও স্বাদ নিয়ে। তিনি বলেন, এমন পরিবেশ সবখানে নেই। বরফে বড় বড় রূপালি ইলিশ সাজিয়ে রাখা। পছন্দের ইলিশ নিয়ে তাৎক্ষণিক কেটে চোখের সামনে ঘাঁটি সরিষার তেলে ফ্রেসভাবে ভাজা করে খাওয়া স্বাদ বড় ভাল লাগে। তাই বার বার আসি। পদ্মা সেতু চালু হয়েছে তাই আরও বেশি আসা হবে। সেতু ঘুরে এসে খেতে এখানেই আসতে হবে। কারণ এমন পরিবেশ পাব কোথায়।  ইলিশ রেস্তোরাঁ হাটের সভাপতি মুরাদ খান বলেন, সেতু চালু হলে সবখানে ঘাট মরে যায়। আর এখানে হবে উল্টো চিত্র। ঘাট আরও সরব হবে।

তিনি বলেন, আর পাঁচটা দিন অপেক্ষা করেই তা নিজের চোখে দেখতে পারবেন। তিনি বলেন, এই ঘাটে লাখ লাখ লোক আসে। এদের অধিকাংশ আছে ইলিশ খেতে। ঘাট পার হতে যারা আছেন তারা কেউ কেউ ইলিশের স্বাদ নিলেও সংখ্যায় কম। সেতু চালু হওয়ায়, তাই ফেরি কমে গেলেও ঘাটের রেস্তোরাঁ ব্যবসায় কোন প্রভাব পড়বে না, বরং আরও বাড়বে। আর সেই আশায় কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে রুচিশীল আকর্ষণীয় রেস্তোরাঁ করা হচ্ছে। যা আরও বেড়ে যাবে।  আরেকটি সারা জাগানো রেস্তোরাঁ ‘শখের হাঁড়ি’। পাঁচ বন্ধু মিলে প্রায় ৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে এই রেস্তোরাঁয়। দেশী-বিদেশী অনেকে আসেন এই রেস্তোরাঁয়। নান্দনিক পরিবেশে ইলিশের স্বাদ নিতে আসা মানুষ এখানকার সব রেস্তোরাঁয়ই স্বাদ পায়। তাই কোনটিতেই ভিড় কম নয়। ছুটির দিনে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। ‘শখের হাঁড়ি’র পরিচালক মাসুম আহম্মেদ জানান, এখানে রেস্তোরাঁগুলো ভিন্ন মাত্রা তৈরি করেছে। তাই অনেকেই বিদেশ না গিয়ে এখানেই বিনিয়োগ করে সফল হচ্ছেন।

তরুণ উদ্যোক্তা ফারহাদ হোসেন ইমন নতুন হোটেল দিয়ে ভাল ব্যবসা করছেন বলে জানালেন। বলনে, লোকজন খেয়ে তৃপ্তি পায় তাই আসে। আমরা ব্যবহার ভাল করি, দামও সহজলভ্য করার চেষ্টা করি।

‘শখের ইলিশ’ নামের রেস্তোরাঁয় প্রায় ৮০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন বিদেশ যাত্রা বাতিল করা শাকিল, ইউসুফ, মানিক, বিটু ও সাইফুল। তারা বলেন, বিদেশ না গিয়ে ভালই করেছি। করোনার কারণে তাদের বিদেশ যাত্রা বিঘ্নিত হয়। পরে তারা এই ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন। জাপান ফেরত শাহিন মিয়া ঢাকায় ব্যবসা থাকা সত্ত্বেও ‘রুপালী ইলিশ’ নামে রেস্তোরাঁ খুলেছেন। সঙ্গে পাটনার নিয়েছেন বন্ধু মোস্তাক হোসেনকে। দুজনই ভাল আছেন এই রেস্তোরাঁ চালিয়ে। এছাড়া রাসেল আলম রাজু, আলী মর্তুজাসহ অনেকেই এই রেস্তোরাঁয় খুলে ভাল সফল হয়েছেন। এই হাটে ‘নিরালা হোটেল’ একটি বিশেষ আস্থা অর্জন করেছে। তাই এই হোটেলের কদরও কম নয়। এটির মালিক মো. মাসুদ এই হাটের সাধারণ সম্পাদক। তিনি মনে করেন, পদ্মা সেতু তাদের ভাগ্য খুলে দিয়েছে। এই অঞ্চলের মানুষের ব্যবসা বাণিজ্য ছাড়াও আর্থ সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন এনে দিয়েছে। সেতু চালুর পর আরও বৈপ্লবিক পরিবর্তন হবে।

হোটেলগুলোতে দেড় শতাধিক নারী রয়েছেন। যারা মাছ কাটা, মসলা বাটা, সবজি কাটাসহ নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন। তাদের একজন সুমি আক্তার বলেন, এই হোটেল গুলান আমাগো কর্ম দিয়েছে, খেয়ে পরে ভাল আছি। পদ্মা সেতুর কারণেই আমাগো এহানে হোটেল ভাল চলে। দিন দিন ভিড়ও বাড়তাছে। এত হোটেল কয় দিনের মধ্যে বাইরা গেল। কিন্তু এরপরও লোক জায়গা দেয়া যায় না।

বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক বলেন, পদ্মা সেতু এবং পদ্মার রূপ দেখতে এখন মানুষের ঢল। তাই বিআইডব্লিউটিএ পদ্মা পারে আসা মানুষের সুবিধা নিশ্চিত করতে নানা পরিকল্পনা এরই মধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে। শীঘ্রই তা দৃশ্যমান হবে।

নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, শিমুলিয়া ফেরি ঘাট বন্ধ হবে না। পণ্যবাহী যানের জন্য ফেরি ঘাটের চাহিদা থাকবে। তবে ঘাটে কোলাহল আরও বাড়বে বলে তার প্রত্যাশা।

কিন্তু এমন সম্ভাবনার মধ্যেও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রবেশদ্বার শিমুলিয়া ঘাট নামে পরিচিত মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া নদী বন্দর কেন্দ্রিক কয়েক হাজার মানুষ যে দুশ্চিন্তা করছিলেন। মন্ত্রীর এই কথায় তারা আশাবাদী। তবে কেউ কেউ বিকল্প কর্মসংস্থান বা পেশা বদল নয় আরও উন্নত পেশায় যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন।

পদ্মা সেতু নির্মাণের লক্ষ্যে ২০১৪ সালে মাওয়া থেকে শিমুলিয়ায় ঘাট স্থানান্তর করা হয়। ভ্রাম্যমাণ দোকানি ও হকাররাও তখন মাওয়া থেকে শিমুলিয়া ঘাটে চলে আসে। সেই থেকে এখানে ৮ বছর অতিক্রম করেছে ঘাট। চলতি মাসের ২৫ তারিখে পদ্মা সেতু চালু হলে এসব কর্মজীবী মানুষ কাজ হারানোর শঙ্কা এখন নেই বলেই মনে করছেন। কারণ ঘাট মরে যাচ্ছে না বরং আরও সমৃদ্ধ হচ্ছে। রবিবার শিমুলিয়া ঘাট এলাকা সরেজমিন ঘুরে ঘাটে কথা বলে এমনটাই মনে হয়েছে।

স্থানীয় সংসদ সদস্য অধ্যাপক সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি বলেন, শিমুলিয়াকে আরও কিভাবে সাজানো যায় তা নিয়ে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। এখন শিমুলিয়া একটি বিনোদন কেন্দ্রের মতো। তিনি বলেন, পদ্মার ইলিশ হচ্ছে জগদ্বিখ্যাত। এখন পদ্মা সেতু আর ইলিশ একাকার। সেতুর কারণে পদ্মাকে অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছে সরকার। তাই ইলিশ উৎপাদন আরও বাড়ছে। লৌহজং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল বলেন, আগত মানুষদের সাচ্ছন্দ্য ধরে রাখতে ব্যবসায়ীদেরও ভূমিকা থাকতে হবে। তাহলে প্রসার বাড়বেই।

আনন্দের আড়ালে

পদ্মা সেতু চালু হওয়ার ফলে শিমুলিয়া ঘাট কেন্দ্রিক কিছু মানুষ  পেশা পরিবর্তন করছেন। এর প্রভাব পড়েছে স্থানীয়ভাবে শিমুলিয়া ঘাটে যারা কর্মরত ছিলেন তারা প্রতিদিন টাকা কামাই করে ঘরে ফিরতেন। এখন আয়-রোজগার কম। অটোরিকশা, ইজিবাইক চালকেরা প্রতিদিন ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা উপার্জন করতেন। এখন ৩০০/৪০০ টাকা কামাই করতেই গলদঘর্ম হচ্ছেন।

শিমুলিয়া ঘাট চালু থাকা অবস্থায় লৌহজং উপজেলার সর্বত্র যে রমরমা ভাব ছিল, এখন হ্রাস পেয়েছে। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে পদ্মা সেতুতে প্রতিদিন হাজার হাজার যানবাহন পারাপার হচ্ছে। কিন্তু সেতুর নিচে মাওয়া বাজার, কুমারভোগ গ্রাম যেন আলোর নিচে অন্ধকার। সেতু হওয়ার কারণে যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তারা জমির কয়েকগুণ দাম ছাড়াও পুনর্বাসিত হয়েছেন। পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোর পরিবেশ চমৎকার। কেন্দ্রের ভেতরে রয়েছে স্কুল, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, পুকুর, বাজার, মসজিদ ইত্যাদি। সর্বোপরি দেশের সর্বোচ্চ ব্যয়বহুল প্রকল্প এই লৌহজং উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে।

এটা নিঃসন্দেহে গর্বের বিষয়। স্থানীয়দের অভিমত, পদ্মা পারাপারে দূর হয়েছে যুগ যুগের সব ভোগান্তি। লৌহজং উপজেলার বুক চিরে পদ্মা সেতু হলেও এ অঞ্চলের ঘাট কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। স্বপ্নজয়ের আনন্দের আড়ালে পেশা বদলের উদ্বেগ চোখেমুখে। ঘাটকে ঘিরে যাদের সংসারের জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে তাদের সমস্যা কিছু হয়েছে। যুগ যুগ ধরে আগলে রাখা পেশা হঠাৎ করেই ছাড়তে হচ্ছে। তাই স্বপ্নজয়ের পদ্মা সেতু চালুর আনন্দের পাশাপাশি পেশা নিয়ে চিন্তার ভাঁজ দেখা দিয়েছে তাদের কপালে। ঘাট না থাকলে এই পেশাও থাকছে না আর। নৌরুটে ৮৭টি লঞ্চ ও দেড় শতাধিক স্পিডবোটের অধিকাংই অলস সময় কাটাচ্ছে। যাত্রী একেবারেই কম। আর শিমুলিয়া-মাঝিরকান্দি নৌরুটে নাব্য সঙ্কটে ফেরি একেবারেই বন্ধ। পাঁচটি ফেরিই অলস এখন।   এ সকল নৌযানে প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী নিয়মিত পার হতেন। এই যাত্রীদের ওপর নির্ভর করে হকার শ্রেণীর ব্যবসাও ছিল জমজমাট। লৌহজংয়ের শিমুলিয়া ঘাটের হকার ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিমুলিয়া ঘাট কেন্দ্র ঘিরে যারা জীবিকা নির্বাহ করছেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে নিরীহ হচ্ছেন ঘাটের হকার শ্রেণী।

যারা লঞ্চে, বাদাম, ফেরিতে ঘুরে ঘুরে যাত্রীদের কাছে বিক্রি করেন ঝালমুড়ি, বাদাম, ছোলা, আচার, সেদ্ধ ডিম, সিঙ্গাড়া, নারকেল চিড়া, শসা, দইসহ নানা রকম মুখরোচক খাবার। প্রতিটি লঞ্চে তিন থেকে চারজন করে নানান জিনিস নিয়ে উঠতেন হকাররা। ঘাটের পন্টুনে ঘুরে ঘুরেও বিক্রি করেন অনেকে লঞ্চ, ¯িপডবোট এবং ফেরিঘাটে ঘুরে ঘুরে অসংখ্য হকার শ্রেণী নানা রকম দ্রব্যাদি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছিলেন। ঘাট দিয়ে যাতায়াতকারী হাজার হাজার যাত্রীই তাদের ক্রেতা। যাত্রীদের খুশি করে বিক্রি করাই তাদের কাজ। সেতু চালুর পর হকারদের বেচা কেনা একেবারেই তলানিতে।

পদ্মা সেতু ঘিরে মিলনমেলা

পদ্মা সেতু প্রাণী জাদুঘরে এখন প্রাণী জগতের মিলনমেলা। এই সংগ্রহ শালায় পেয়েছে ১৪১৯ প্রজাতির ২১২৮  প্রাণীসহ ২৩৫৬টি নমুনা। প্রাণীগুলোকে এমনভাবে রাখা হয়েছে এই জাদুঘরে এসে যে কারোরই মনে ভরে যাবে। কর্তৃপক্ষ বলছে দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ এই প্রাণী জাদুঘর শুধু বিনোদনই নয় গবেষণায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী বিভাগের তত্ত্বাবধানে গড়ে তোলা এই জাদু ঘরে দুর্লভ প্রাণীও স্থান পেয়েছে। পদ্মা সেতুর প্রকল্প এলাকা ১ নম্বর সার্ভিস এরিয়ায় এই জাদুঘরটির স্থান। তাই এখনো এই জাদুঘর সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়নি, তবে নকশা প্রণয়ন হয়েছে শীঘ্রই নতুন ভবন করে এটি সরিয়ে নেয়া হবে। একই সঙ্গে থাকবে পদ্মা সেতু জাদুঘর। এই জাদুঘরে স্থান পাচ্ছে সেতুর নির্মাণ শৈলীর সব রকমে রিপ্লিকা। সেতুর তলদেশের নরম মাটিতে পাইল স্থাপনের উদ্ভাবনী কৌশল, বড় মাপের ভূমিক¤প মোকাবিলার বেয়ারিংসহ ভিন্ন ভিন্ন সব কিছুই। জাদুঘরে থাকবে সেতুটি তৈরিতে ব্যবহৃত হ্যামারসহ নানা রকমের আলোচিত যস্ত্রপাতির রিপ্লিকা। আর জাদুঘর ভবনের বাইরে স্থাপন করা হবে সেতুর স্প্যান।

এই জাদুঘর পূর্ণাঙ্গ রূপ নিলে দেশের প্রকৌশল গবেষণায় বড় অবদান রাখবে। আকৃষ্ট করবে দেশী-বিদেশী পর্যটক। তাই পদ্মা সেতু শুধু যোগাযোগই নয় এই অঞ্চলের ঐতিহ্য রক্ষণেও অবদান রাখছে।

পদ্মা সেতু নির্মাণের পাশাপাশি পদ্মা অববাহিকার বন্য ও জলজ প্রাণী নিয়ে গবেষণায় বড় ভূমিকা রাখবে এই সংগ্রহশালা বলে জানিয়েছেন প্রাণী জাদুঘরটির সার্ভিস প্রভাইডার রিপ্রেজেন্টেটিভ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী বিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এম নিয়ামুল নাসের। তিনি মনে করেন এই সংগ্রহশালা পর্যটকদের আকৃষ্ট করার পাশাপাশি নতুন প্রজন্মকে প্রকৃতি প্রেমী করতে সহায়ক হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠছে জাদুঘরটি। ২০১৬ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের কাজ এখনও শেষ পর্যায়ে। পদ্মা অববাহিকার জেলা শরীয়তপুর, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ ও অঞ্চলের প্রাণী নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে পদ্মা সেতু প্রাণী জাদুঘর। সেতু বিভাগের কাছে হস্তান্তরের পর পদ্মা সেতু প্রাণী জাদুঘর উন্মুক্ত হবে সর্বসাধারণের জন্য। জঙ্গল নয় তবে এখানে আছে বন দাপিয়ে বেড়ানো সব প্রাণী। মগ ডালে বসে প্রহর গুনছে হারিয়ে যাওয়া এক বাংলা শকুন। একটু পাশেই উঁকি দিচ্ছে হিমালয় শকুন। গন্ধগোকুল আড়মোড়া ভাঙছে সতর্কভাবে। গাছ থেকে গাছে উড়ে বেড়ানো প্যাঁচা, বাদুড়, চিলসহ শিকারী পাখির সংগ্রহও কম নয়। দেখা মিললো পরিচিত বানরেও। পদ্মা নদীতে পাওয়া শুকুকের হাড় দিয়ে সাজানো হচ্ছে কংকাল। চকচকে চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে শিয়াল। ঝোপঝাড়ে ইঁদুর খাবার ছিনিয়ে নিতে প্রস্তুত। মৃত প্রাণীর চামড়া দিয়ে বানানো নমুনা দেখে জীবন্ত ভাবতে পারেন যে কেউ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা চেয়ারম্যান অধ্যাপক নিয়ামুল নাসের জানান, পরবর্তী প্রজন্ম যখন এখানে আসবে, তখন দেখতে পাবে পদ্মা নদীর আশপাশে কি ছিল। দায়িত্বশীলরা বলছেন, কিছু প্রাণী আছে এই এলাকার তালিকাভুক্ত করা কিন্তু অত্যন্ত দুর্লভ বলে এখানে পাওয়া সম্ভব না। যার কারণে অন্য এলাকায় যখন যে প্রাণী মারা যাচ্ছে তা সংগ্রহ করা হচ্ছে। বছর দুয়েক আগে পদ্মায় ধরা পড়া প্রায় আড়াই কেজি ওজনের ইলিশটি সাজিয়ে রাখা হয়েছে কাঁচের বাক্সে। কাজুলি, উজুক্কু, শিং, আইড়সহ নানা প্রজাতির মাছের দেখা মিলছে এই জাদুঘরে। পদ্মার গলদা চিংড়ি, শামুক, ঝিনুক, ব্যাঙ সাপসহ এই অববাহিকার বিলুপ্ত প্রায় বন্যপ্রাণীর নমুনাও সংগ্রহ করা হয়েছে। মাছ শিকারের নানা উপকরণও সাজিয়ে রাখা হয়েছে থরে থরে। কিউরেটর সুমন মন্ডল বলেন, রক্ষণাবেক্ষণে গ্রহণ করা হয়েছে আধুনিক এবং বিশ্বমানের প্রযুক্তি। প্রাণীগুলো মৃত অবস্থায় নানা স্থান থেকে সংগ্রহের পর তা প্রক্রিয়া করে এখানে প্রদর্শন করা হয়।

পদ্মা সেতু বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য

পদ্মা সেতু ঘিরে জীববৈচিত্র্য রক্ষায়  চার জেলার নদী তীর ও পদ্মার বিশাল এলাকা অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছে সরকার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঘোষণাটি বাস্তবায়ন হলে, পদ্মার বুকে সেতু নির্মাণের কারণে জীব বৈচিত্র্যে প্রভাব মোকাবেলার পাশাপাশি পুরো এলাকার প্রকৃতি স্বরূপে ফিরবে। জলজ প্রাণীর বিচরণের পাশাপাশি বাড়বে মাছের উৎপাদন। বিশাল পদ্মার মাওয়া প্রান্ত আর জাজিরার সঙ্গে বন্ধন তৈরি করা স্বপ্নের পদ্মা সেতু ঘিরে পরিবেশের যাতে কোন ক্ষতি না হয় সে জন্য। গ্রহণ করা হয়েছে নানা পরিকল্পনা সেতু ঘিরে জীব বৈচিত্র্যের ক্ষতিকর প্রভাবমুক্ত রাখতে পুরো এলাকা সুরক্ষায় জলাভূমির বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদ বৈচিত্র সংরক্ষণ এবং বংশবৃদ্ধির লক্ষ্যে পদ্মা সেতু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করেছে  সরকার। উদ্ভিদ, জলজ প্রাণী ছাড়াও এখানে নানা প্রজাতির পাখি গাছপালা ও লতাগুল্ম রয়েছে। এই প্রকল্পের টিম লিডার ড. এস এম এ রশিদ জানান, এতে এই অঞ্চলের  জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা করা যাবে। সরকারের এই পদক্ষেপ  বাস্তবায়নে সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন। ‘জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ কার্যক্রম, পদ্মা সেতু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য’ নামের এই কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে এখন পুরো এলাকায়।

পৌনে ২ লাখ বৃক্ষরোপণ

পদ্মা সেতুর প্রকল্প এলাকার বেশিরভাগ স্থানই এখন ঘন সবুজ।  চারদিকে নানা রকমের বৃক্ষ ছায়া দিচ্ছে, ফল দিচ্ছে, অক্সিজেন ছাড়াও পুরো এলাকায় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বড় অবদান রাখছে। পরিকল্পিত বনায়নের এলাকার প্রকৃতি পাল্টে গেছে। প্রকল্পের সাতটি পুনর্বাসন কেন্দ্র, তিনটি সার্ভিস এরিয়া, জাজিরা ও মাওয়া এ্যাপ্রোচ রোড এবং আশপাশে ২০১২ থেকে এ পর্যন্ত  ১ লাখ ৭৩ হাজার ২৯৪টি বৃক্ষ রোপণ করেছে সেতু বিভাগ। জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণেও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মোঃ শফিকুল ইসলাম বলেন, গাছগুলো রোপণের পর পরিচর্যার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তাই এই সবুজায়ন। সরকার ঘোষিত অভয়ারণ্য কার্যকর হলে পদ্মা ফিরে পাবে হারানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। ঐতিহ্যবাহী রুপালি ইলিশসহ সব মাছের প্রসার আরও বাড়বে। পদ্মা পাড়ের বাসিন্দা ভজন দাস বলেন, পদ্মা হচ্ছে অনেক বড় খনি। পরিবেশ ঠিক থাকল। এখান থেকে যে মাছ আরোহণ করা যাবে তা দেশের মৎস্য খাতে বড় অবদান রাখবে। মুন্সীগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য অধ্যাপক সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি জনকণ্ঠকে বলেন, সরকারের সুপ্রসারী পরিকল্পনার কারণে এলাকার পরিবেশ সুরক্ষা হচ্ছে।

সবুজে ঘেরা উপশহর

মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার কুমারভোগ ইউনিয়ন মাওয়া চৌরাস্তা মোড়ের কাছেই পদ্মা বহুমুখী সেতু পুনর্বাসন কেন্দ্র নামে পরিচিত। যেন পদ্মা পাড়ের এক খন্ড সবুজ বেষ্টন। প্রবেশ দ্বারেই চোখ জুড়ানো রকমারি ফলদ, ঔষধি ও ফুল গাছের সারি। মাঝে নান্দনিক মসজিদ। মসৃণ পিচঢালা পথ। পুকুরপাড়ে কংক্রিটের ঢালাই। প্রাথমিক বিদ্যালয়টিও সেজেছে নান্দনিক সাজে। পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনেরও দরুণ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে সেতু পাড়ের এ পুনর্বাসন এলাকায়। পুনর্বাসন কেন্দ্রের গেট থেকে কয়েক পা হাঁটতেই দেখা যায় পরিকল্পিত একটি মসজিদ। আসরের নামাজ পড়ে বের হয়েছেন কয়েকজন মুসল্লি। যাদের অধিকাংশই হাজী। সবাই পুনর্বাসন কেন্দ্রের পরিবেশে খুশি। এই পরিবেশকে সবাই গুলশান-বনানীর সঙ্গে তুলনা করেন।

শেয়ার করুন-

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2021 purbobangla