কয়ছার উদ্দীন আল-মালেকী
যৌতুক প্রথা একটি সামাজিক কুসংস্কার। যাকে ঘিরে প্রতি দিন-রাত ঘটছে নারী নির্যাতন আর নিপীড়নের বীভৎস চিত্র। প্রতিদিন শারীরিক মানসিক নির্যাতনের বলির পাঁঠা হচ্ছেন নারীরা। নারী নির্যাতনের আর্তনাতে কাঁদছে পৃথিবীর আকাশ-বাতাস। নর-নারীর যুগল জীবন পদার্পণের পূর্বে বর পক্ষ কনে পক্ষ হতে দর কষাকষির মাধ্যমে জোরজবরদস্তি ভাবে নগদ অর্থ, স্বর্ণালঙ্কার, ফার্নিচার, টিভি, ফ্রিজ, মোটরযান ইত্যাদি মূল্যবান জিনিস পত্র নেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে চুক্তিবদ্ধ হওয়াই হল যৌতুক। যৌতুক প্রথার প্রধান কারণ সমূহ হচ্ছে অর্থলোভ, কুৎসিত বা শারীরিক প্রতিবন্ধী, পুরুষশাসিত সমাজে মহিলাদের প্রতি ঋণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি, নারীদের পরনির্ভরশীলতা, পুরুষের প্রতিষ্টা লাভের মনোভাব ও সামাজিক দুর্নীতি।
ইসলাম শাস্ত্রে যৌতুকের কোন স্থান নেই। ইসলামী আইন অনুযায়ী, বিবাহ হল একজন নারী ও একজন পুরুষের মধ্যে নিষ্পন্ন বৈধ বন্ধন ও সামাজিক চুক্তি । বৈধ বৈবাহিক বন্ধন কে ইসলাম উৎসাহিত করেছে। একজন ব্যক্তি তখনই বিবাহের বয়সী হবেন, যখন সে মানসিক, দৈহিক ও আর্থিকভাবে বৈবাহিক জীবন নির্বাহ করতে সমর্থ হবেন। কিন্তু যৌতুক প্রথার প্রাদুর্ভাবের কারণে হাজারো সংসার অকালে ভেঙ্গে যাচ্ছে। কত নারী অসহায় পরিবার কে বাঁচাতে মুত্যুকে হাসিমুখে মেনে নিয়ে আত্মহত্যা করছে। কত ছেলেমেয়ে মা হারাচ্ছে, কত মা-বাবা মেয়ে হারাচ্ছে তা আসলেই আমাদের ভাবিয়ে তুলছে না। এ নির্মম দৃশ্যপট প্রতিদিন ভেসে আসছে পত্র-পত্রিকার নিউজে ও টিভির পর্দায়। আপনি আজকে যৌতুক নিচ্ছেন, কালকে (বোনের কিংবা নিকটাত্মীয়দের বিবাহের সময়) আপনাকে যৌতুক দিতে হবে। এ সুক্ষ বিষয়গুলো কী আপনাকে ভাবায় না ? চট্টগ্রামের ভাষায় একটি প্রবাদ আছে, পাঠা ছাগলকে জবেহ করলে পাঠি হাসে, তখনি পাঠা বলে উঠে, ও পাঠি! তুর জন্যও এমন সময় অপেক্ষা করছে।
যৌতুক প্রথা নারী নির্যাতনেরই এক বীভৎস রূপ। হিন্দু প্রথাই যৌতুক প্রথার উদ্ভাবক। মুসলিম সমাজে আধুনিকতার নামে অনৈসলামিক যৌতুক প্রথা অনুপ্রবেশ করেছে। হিন্দু সমাজে প্রথাটি প্রতিষ্ঠিত, এজন্য তাদের জন্য আমার লিখাটি প্রযোজ্য নয়। আমার লিখাটি মুসলমানদের জন্য। যারা অর্থলোভে পাত্রী গ্রহণ করতে চায়। যারা বছরের বিভিন্ন উৎসবে উপটোকন হিসেবে ভিক্ষা নিতে চায়। আসলেই তাঁরা মুসলমান নামধারী, বেঈমান মুখোশদারি, যুগের শ্রেষ্ঠ নষ্ট কাপুরুষ। এ রকম ভিক্ষাবৃত্তির স্থান ইসলামে নেই । বরঞ্চ যারা পরের হক নষ্ট বা আত্মসাৎ করে তারা দুনিয়াতে লাঞ্চনা ও অপদস্ততা স্বীকার হন। অনুরূপে আখেরাতেও তাদের জন্য কঠিন ও ভয়ংকর শাস্তি সুনিশ্চিত। কুরবানিতে যারা ফকির মিসকিনের মত গরু, ছাগলের জন্য হাত পাততে চায়। তারা আসলে জন্মগতভাবে ফকির। এটা তাদের হীনম্মন্যতা নয় বরঞ্চ মুদ্রাদোষ। যৌতুকের বিরূপ প্রভাবটা মূলত গরীব সমাজের উপর বেশি প্রভাব বিস্তার করে। এ কারণে এ পরিবার গুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও ঋণগ্রস্ত হয়। যৌতুকের জন্য যারা বিবাহ যুদ্ধে নেমে পড়েন তারা নিশ্চয়ই নির্লজ্জ কাপুরুষ। কারণ তাদের মধ্যে মনুষ্যত্ব লোপ পায় হিংস্রতা বৃদ্ধি পায়। তারা আসলেই দানব। তাঁরা মানুষের কাতারে পড়ে না। মানুষের মাঝে দানব বা হিংস্র প্রাণীর বৈশিষ্ট্য দৃশ্যমান হলে বুঝতে হবে সে নিশ্চয়ই নষ্ট জন্মের নিকৃষ্ট ফসল। সে উর্বর মাটিতে বিনা ইনভেস্টে ফসল বুনতে চায়। অথচ স্ত্রীকে দেনমোহর গুলো সঠিকভাবে প্রদেয় করে না। স্ত্রীকে তাঁর ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। স্ত্রীর প্রতি যত্নশীল নয়। স্ত্রীকে গোলাম বা দাসী মনে করে। অথচ ইসলামে, স্ত্রীকে স্বামীর কাছে আমানত হিসেবে ন্যস্ত করেছে। কিন্তু সেই আমানতকে যথাযথা ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করে না। আমানতের খেয়ানতদারিতা করে। যারা আমানত খেয়ানত করে তারা নিশ্চয়ই মুনাফিক। পরকালে মুনাফিকের স্থান জাহান্নামের সর্বনিকৃষ্ট স্তরে থাকবে। বেআমানতদারীর ব্যাপারে হাদিসে কঠিন শাস্তির কথা উচ্চারিত হয়েছে। বস্তুত মামলা-হামলা দিয়ে যৌতুক বন্ধ করা যাবে না। মানুষের শুভ বুদ্ধির উদয় না হলে এবং মনুষ্যত্ব ফিরে না আসলে যৌতুক প্রথা বন্ধ হবে না। অথচ কবি নজরুল তাঁর কবিতায় লিখেছেন, “বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।” নারী সৃষ্টি সৃজনে, মননে শক্তি জোগায়। অভিষ্ট লক্ষে পৌঁছতে সহায়তা করে। প্রতিটি মানুষের বিজয়ের পেছনে একজন নারীর অবদান থাকে। অথচ আমরা সে নারী জাতিকে অসম্মান, অশ্রদ্ধা, অবহেলা, অপমান করছি। আসুন, আমরা যৌতুক মুক্ত সমাজ গড়ি। যৌতুকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। সুন্দর সমাজ বিনির্মাণ করি।