মাহমুদুল হক আনসারী
চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে বিএম ডিপোতে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে গোটা জাতি স্তব্ধ। এ ধরনের ভয়াবহ অগ্নিকান্ড বাংলাদেশে ইতিপূর্বে দেখা যায়নি। ছোটখাট অগ্নিকান্ড বিভিন্ন এলাকাতে হয়েছে, শিল্প অঞ্চলে হয়েছে। পোশাক রপ্তানি জাতক এলাকাতে হঠাৎ করে দূর্ঘটনার আগুন দেখা গেছে। বিভিন্ন বাণিজ্য মার্কেটে যে কোন কারণে আগুন লাগতে দেখা গেছে। বস্তি এলাকায় আগুন ধরেছে সর্বশান্ত হয়েছে তা দেখা গেছে। তার কারণ নির্ণয় করা গেছে এবং ক্ষতিপূরণে প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে। এসব অগ্নিকান্ডের নানা কারণ তথ্য উপাত্ত তদন্ত কমিটির মাধ্যমে জাতি জানতে পেরেছে।
কিন্তু সীতাকুন্ডে বিএম ঘাটিতে ৪জুুন শনিবার যে অগ্নিকান্ড এবং ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়েছে সেটা দেশের অন্য যেকোন অগ্নিকান্ড থেকে ভিন্ন প্রকৃতির। এটাকে শুধুমাত্র অগ্নিকান্ড হিসেবে চিহ্নিত করা যায়না। এটা একটা কয়েক কিলোমিটার এলাকার বিশাল এক ডিপো। এখানে সব ধরনের নিরাপত্তা রয়েছে। যে প্রতিষ্ঠান এ ডিপোটি পরিচালনা করছে তাদের কয়েক হাজার কর্মকর্তা কর্মচারী ডিপোর কার্যক্রমে নিয়োজিত ছিল। ডিপোটি কী কী কাজে ব্যবহার করা হতো সেটা ইতিমধ্যে দেশবাসী জানতে পেরেছে। তাদের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বক্তব্য জানা গেছে। বিষয়টি হচ্ছে এত বড় দূর্ঘটনা কীভাবে হলো? সেটি এখন গোটা দেশবাসী পরিস্কারভাবে জানতে চায়। কারণ এখানে কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করত। তারা কীভাবে কাজ করত , কী কাজ ছিল তাদের এসব অন্ধকারে রয়েছে। মূলত এই ডিপোতে কী কী পণ্য রাখা হত এবং তা ডেলিভারী দেওয়া হতো তাও রহস্যে ঘেরা। প্রশাসন থেকে কী কী ধরনের পণ্যবাহী গাড়ির অনুমতি নেওয়া হয়েছে তাও জানা হয়নি। কী পণ্যের মধ্যে কী কী পণ্য সেখানে লোড আনলোড হতো এসব বিষয় বেমালুম প্রশাসন এবং জনগণ।
সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং দপ্তর গুলো থেকে ওই কন্টেইনার ডিপোর ব্যবহারের যাবতীয় অনুমতি কর্তৃপক্ষ নিয়েছে কিনা সেটাও পরিস্কার করতে হবে। মিল কারখানা ইন্ড্রাষ্ট্রী ডিপো করার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ অনুমতি ছাড়পত্র প্রয়োজন। সেটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে যথাযথভাবে দেখতে হবে। যারা এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে তাদেরকে অবশ্যই সরকারের নিয়মনীতি গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করতে হবে। পেশি শক্তির জোরে অথবা অর্থের দাপট দেখিয়ে কাউকে আইনের উর্ধ্বে চলতে দেয়া যায়না। এসব অগ্নিকান্ডের কারণ দেশ এবং জাতির ভাবমূর্তির জন্য বড় ধরনের অন্তরায়। দেশি বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা এসব পর্যবেক্ষণ করছে। বাংলাদেশ তার ব্যবসা বাণিজ্য শিল্প কারখানা কীভাবে পরিচালনা করছে তা দেখার অনেক সংস্থা বাংলাদেশে আছে। সুতরাং যেনতেন ভাবে কোনো ইন্ড্রাষ্ট্রিয়াল এরিয়া কন্টেইনার ডিপো শিল্প কারখানাকে অনুমতি দেওয়া যায় না। রাজনীতি জনগণকে নিয়ে রাজনীতির মাঠে চালাতে হবে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শিল্প কারখানায় কোনো ধরনের রাজনৈতিক চিন্তা চেতনায় অনুমতি প্রদান বাঞ্চনীয় নয়। দলীয় পরিচয়ে কাউকে অনুমতি আবার যা ইচ্ছে তা করার সুযোগ দেওয়া কোনো অবস্থায় মেনে নেয়া যায়না। বিশাল এ অগ্নিকান্ডের কারণে শত শত পরিবার তাদের সদস্যকে হারিয়েছে। এসব পরিবারের কান্নায় আকাশ বাতাস আজ চট্টগ্রামে ভারি হয়ে ওঠছে।
যেকোন মূল্যে এ অগ্নিকান্ডের কারণ নির্ণয় করতে হবে। এসব ডিপোতে এবং সব ধরনের শিল্প কারখানায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। জনবসতিকে কোনো অবস্থায় যেকোন ধরনের শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা অনুমতি বন্ধ করতে হবে। জান মালের নিরাপত্তার জন্য জনবসতিপূর্ণ এলাকার বাইরে শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ দূর্ঘটনা কী কারণে কিভাবে হয়েছে তা খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশবাসীকে জানাতে হবে। কারণ নির্ণয় করে যে বা যারা এ দূর্ঘটনার সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে আইনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ইতিমধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করেছে তাদেরকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আর যারা আহত হয়েছে তারা সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তাদের চিকিৎসা চালাতে হবে। আর তাদের পরিবার পরিজনের খবর রাখতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। দেশবাসী এ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। মালিক এবং ক্ষতিগ্রস্থ সকলেই যেনো ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেন সে প্রত্যাশা করছে। আর যেনো এ ধরনের দূর্ঘটনা জাতিকে দেখতে না হয় সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সার্বিক ব্যবস্থা সবসময় রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের প্রতি দাবি জানাচ্ছে।
এ কন্টেইনার টার্মিনালে আগুন লেগে এ পর্যন্ত ৪০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে, সেই টার্মিনালটি নেদারল্যান্ডস-বাংলাদেশ যৌথ মালিকানায় তৈরি হয়েছে ২০১১ সালে। বিএম কনটেইনার ডিপো নামে ওই কোম্পানির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এটি একটি জয়েন্ট ভেনচার কোম্পানি। ২০১১ সালে চট্টগ্রামের প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে সীতাকুন্ডে এই অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপোটি স্থাপন করা হয়।
ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, নেদারল্যান্ডসের নাগরিক বার্ট প্রঙ্ক কোম্পানির চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশের মোস্তাফিজুর রহমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক।২০১১ সালের মে মাস থেকে এই টার্মিনালটি কার্যক্রম শুরু করে।
বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে পাঠানো রপ্তানি পণ্য অথবা আমদানি করা পণ্য কন্টেইনারে করে এই ডিপোতে এনে জমা করা হয়। এরপর সেটি জাহাজে করে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয় অথবা দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হয়। রপ্তানিকারক কোম্পানিগুলো এই ডিপোর জায়গা ভাড়া নিয়ে কন্টেইনার রাখে।
কোম্পানি ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার ডিপোগুলোর অন্যতম। সীতাকুন্ডেই এরকম তিনটি বেসরকারি কন্টেইনার ডিপো রয়েছে।
গত ১১ বছর ধরে কোম্পানি রপ্তানি ও আমদানি পণ্যের কনটেইনারাইজড পণ্য খালাস ও বোঝাইয়ের (স্টাফিং/আনস্টাফিং) কাজ করছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ওয়েবসাইটে।
আগুন লাগার সময় রপ্তানির উদ্দেশ্যে রাখা শতাধিক কন্টেইনার ছিল এই ডিপোতে। বর্তমানে ডিপোটিকে সার্বিক নিরাপত্তার মধ্যে আনতে হবে। হতাহতদের জরুরী এবং প্রয়োজনীয় আর্থিক ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। চিকিৎসার সার্বিক ব্যবস্থা পরিচালনা করতে হবে। ইতিমধ্যে ছয়টি তদন্ত কমিটি গঠন হওয়ার সংবাদ পাওয়া গেছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট বাস্তবায়ন করতে হবে। এ অগ্নিকান্ডের কারণে আশপাশের ক্ষতিগ্রস্থ এলাকাবাসীর ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এসব কিছু যথাসময়ে সমাধান করে ডিপোটি পুনরায় চালু করে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল করা হউক।