ভুক্তভোগীসহ সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের অনিয়ম-দুর্নীতির পেছনে রয়েছেন সাব-রেজিস্ট্রার মো মনিরুজ্জামান। তার সঙ্গে রয়েছেন হেড ক্লার্ক জড়িত। তারা দু’জনে মিলে অন্য অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে প্রতিদিনই সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে সেবা নিতে আসা মানুষদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। তাদের মাধ্যমে বেআইনিভাবে জমি রেজিস্ট্রি করে অনেকেই জমির মালিক হয়েছেন।
এদিকে, সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মকর্তা ছাড়াও অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে রয়েছে স্থানীয় দলিল লেখকদের একটি চক্র। প্রান্তিক পর্যায়ের অসহায় ব্যক্তিরা জমি জমা সংক্রান্ত কোনো সমস্যা নিয়ে এলেই সক্রিয় হয়ে ওঠে তারা।সরকারি ফি যতই হোক ঘুষ দিতে হয় ছয় গুণ ।
দলিল করতে আসা ভুক্তভোগীরা জানান, সদর সাব-রেজিস্ট্রারসহ তার অনুসারী এবং দালালরা নানা ধরনের জাল-জালিয়াতিতে জড়িত। প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ বালাম টেম্পারিং ও পাতা ছিড়ে ফেলার মতো অভিযোগ রয়েছে অফিসের রেকর্ড রক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে।সাবেক এক ক্লাক নুরুল আলম পাতা ছিড়ে ফেলার মতো অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন ।
এছাড়াও জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার পথও করে দিয়ে থাকেন কেউ কেউ। জানা গেছে, সাফ-কবলা দলিলের ক্ষেত্রে ৯.৫ শতাংশ হারে রাজস্ব নেওয়ার কথা থাকলেও দাতা ও গ্রহীতাদের জিম্মি করে দলিল লেখকেরা প্রতি লাখে ১৪ শতাংশ হারে টাকা আদায় করা হচ্ছে।
সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে সেবা নিতে আসা এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নাম ব্যবহার করে সাব-রেজিস্ট্রি অফিস এলাকায় দলিল লেখক সমিতির দ্বারা পরিচালিত একটি চক্র রমরমা ব্যবসা চালাচ্ছে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা দলিল দাতা-গ্রহীতাদের কাছ থেকে দলিলের টাকা ছিনিয়ে নেওয়া এবং প্রাণনাশের হুমকির মতোও অভিযোগ রয়েছে এই চক্রের বিরুদ্ধে।’
সদর সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয়ে সরেজমিনে দেখা যায়, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সেবা নিতে আসা ব্যক্তিদের বাইরেও অনেক মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে আশপাশে। ভুক্তভোগীরা জানান, বাইরে ঘুরতে থাকা বেশিরভাগ লোকই দালাল চক্রের সদস্য। অনেক সময় তাদের কারও সঙ্গে কথা না বলে অফিসের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর দেখা পাওয়া যায় না।
অভিযোগের বিষয়ে হেডক্লার্ক বলেন, ‘আমি সাব রেজিস্টার স্যারের নির্দেশে সব কাজ করি। আমি আর কিছু বলতে পারবো না। আপনারা স্যারের সাথে যোগাযোগ করেন।’অথচ স্যারের মোবাইল নাম্বার চাইলেও সাংবাদিক জানার পর নাম্বার নাই বলে সাফ জানিয়ে দেন।চট্টগ্রামে জেলা রেজিষ্টার ও সাব রেজিষ্টারের দায়িত্ব দুই পদেই একজন পালন করেন। ফলে কাজের জটলা লেগেই থাকে। কষ্ট পায় সাধারণ জনগণ । দুই পদে থাকলে অবৈধ আয় বেশী হয় তাই ছলচাতরী করে থাকতে চান মোঃ মনিরুুজ্জামান।যত রেজিষ্ট্রী তত ইনকাম এখানে।
সরকারি ফি যতই হোক তিন সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ঘুষ হিসেবে পাঁচ থেকে ছয় পার্সেন্ট ‘অফিস খরচ’ দিতে হচ্ছে দলিল রেজিস্ট্রি করতে আসা মানুষদের। আদায় করা এ টাকা ভাগাভাগি হচ্ছে সাব-রেজিস্ট্র্রার, দৈনিক ভিত্তিতে কর্মরত নকল নবিশ, কর্ম-সহযোগী ও দালালরা। প্রকাশ্যে ঘুষ নেওয়ার এ চিত্র শুধু সদর সাব-রেজিস্টার অফিসই নয়। এ অফিসের পাশে থাকা চান্দগাঁও সাব-রেজিস্ট্রি অফিস ও পাহাড়তলী সাব-রেজিস্ট্রি অফিসেও একই চিত্র। এ চিত্রগুলো গত ৪ এপ্রিলের । সরেজমিন ৪ ঘণ্টা অবস্থানকালে এসব চিত্র দেখা গেছে চট্টগ্রামের কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় অবস্থিত সদর সাব-রেজিস্ট্রি, চান্দগাঁও সাব-রেজিস্ট্রি ও পাহাড়তলী সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে।
জনৈক সিনিয়র আইনজীবী বলেন, ‘সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিস দুর্নীতির আখড়া। এখানে সরকারি ফি দেওয়ার পরও দুই থেকে তিন পার্সেন্ট টাকা ঘুষ দিতে হয়। তা না দিলে জমির দলিল রেজিস্ট্রি না করে সমস্যার পাহাড় দেখিয়ে দলিলটি ফেলে রাখে। গত সপ্তাহে এক লাখ টাকার জায়গায় ৫০ হাজার টাকা দেওয়ায় দুই দিন ফেলে রাখে আমার দলিলটি।’
আরেক ভুক্তভোগী চট্টগ্রাম জজকোর্টের আইনজীবী বলেন, ‘সদর সাব-রেজিস্ট্রার সাইফুল ইসলাম তার সহকারী বাহার ও মফিজের ওপর আস্থা রাখতে না পারায় নাসির ও ভুট্টু নামে আরও দুজন নিয়োগ দিয়েছেন। সাব-রেজিস্ট্রারের আস্থাভাজন কর্মচারীরাই ঘুষ নিয়ে দ্রুত দলিল রেজিস্ট্র্রি করে দেন। চাহিদা মতো টাকা না পেলে তারা সাব-রেজিস্ট্রারের কক্ষের কাছেও কাউকে যেতে দেন না। গত সপ্তাহে একটি ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রি করতে গিয়ে নাসির ও ভুট্টুর কাছে হয়নারির শিকার হয়েছি।’
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে অফিস সহকারী বলেন, ‘স্যারের ব্যক্তিগত সহযোগী হিসেবে কাজ করলেও কোনো অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ত নই। মাঝে মধ্যে অনেককে বিনা পয়সায় সহযোগিতা করে থাকি।
‘কর্মচারী-দালালের ১৩ জনের সিন্ডিকেট রয়েছে। চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় রয়েছে চট্টগ্রাম সদর, চান্দগাঁও ও পাহাড়তলী সাব-রেজিস্ট্রি অফিস। এসব অফিসে সাব-রেজিস্ট্রারসহ দৈনিক ভিত্তিতে সদরে ১২২ জন নকলনবিশ, চাঁন্দগাঁও অফিসে ২৮ জন নকলনবিশসহ তিন অফিসে নকলনবিশ, কর্ম সহকারী দলিল লেখকসহ দুইশ’ জন কর্মচারী রয়েছেন। তাদের সহযোগিতা নিয়ে সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে টেক্স কালেকটর এরাদুল হক, বাহার ও মফিজের নেতৃত্বে ঘুষ গ্রহণের সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তাদের ছত্রছায়ায় যেসব দালাল সক্রিয় রয়েছে তারা হলেন_ রকিব উদ্দিন, ভুট্টু, শুক্কর, ছুট্টু, বদিউল আলম, মামুন, হোসেন, বাদশা মিয়া, শফিক ও আলম।
এজলাসে নয়, খাস কামরায় বসেই রেজিস্ট্রি করতে দেখা গেছে। সরেজমিন এ দুটি অফিসে অবস্থানকালে তাদের একবারও এজলাসে উঠতে দেখা যায়নি।
সদর সাব-রেজিস্ট্রার মো. মনিরুজ্জামান বলেন আগামী সপ্তাহে জেলা রেজিষ্টার জয়েন্ট করবেন । আমাকে আর ডাবল দায়িত্ব পালন করতে হবে না।