অপরদিকে, একজন কর্মকর্তাকে পদায়নের জন্য নির্দিষ্ট পদের বিপরীতে প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা যথাযথভাবে নির্ধারণ করা নেই। আবার থাকলেও তা কোনো সিস্টেমেই সংরক্ষিত থাকে না বা প্রদর্শন করা হয় না। ফলে সঠিক তথ্যের অভাবে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও উপযুক্ত ব্যক্তিকে যথাস্থানে পদায়ন করা যায় না। মানে অনেক সময় যার যেখানে থাকার কথা না, সে সেখানে পদায়িত হচ্ছে।
অপদিকে কারিগরি পদসমূহে পদায়নের ক্ষেত্রে বিশেষ ধরনের ডিগ্রি, প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা দরকার হয়। সেই বিষয়টিও থোড়াই আমলে নেয়া হয়। ফলে এক ধরনের অলিখিত ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, প্রভাব এবং বাহাদুরি চর্চার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে জনপ্রশাসনে।
সম্প্রতি এক প্রশ্নের জবাবে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সিভিল সার্ভিসের দক্ষতা উন্নয়ন এবং মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। যা পরিবর্তনশীল বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিকায়নের দাবি রাখে। আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব-সিপিটি ড. মো. সহিদউল্লাহ গতকাল সোমবার বলেন, ‘সরকারি কর্মচারী ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি-জিইএমআই নেই। এটা বড় একটা দুর্বলতা। কর্মকর্তাদের পরিপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত না থাকায় পদোন্নতি পদায়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। এটা প্রণয়ন করা দরকার। সরকারি কর্মচারী ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি চূড়ান্ত করে আমরা ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। আর্থিক সংশ্লেষ থাকায় অর্থ বিভাগে পাঠানো হয়েছে বলে তিনি জানান। তিনি আরো বলেন, প্রযুক্তিনির্ভর, আধুনিক, তথ্যসমৃদ্ধ গতিশীল ডেটাবেইজ তৈরি এখন সময়ের দাবি। আশা করি কাজটি শুরু করতে পারব।’
জিইএমএস ঘেঁটে জানা গেছে, তথ্যের অভাব এবং পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে পদায়ন নীতিমালা যুগোপযোগী করা যাচ্ছে না। পদায়ন নীতিমালা হালনাগাদ না হওয়ায় সঠিক বা উপযুক্তদের উপযুক্ত স্থানে পদায়ন সম্ভব হচ্ছে না। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। পদোন্নতির ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের কর্মদক্ষতা, কর্মক্ষেত্রে তার বিশেষ অবদান, বিশেষ অর্জন, সততা, নৈতিকতা, পেশাগতজ্ঞান ও দক্ষতাকে প্রাধান্য না দিয়ে চাকরির মেয়াদকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়।
আগে থেকে সংরক্ষণ না করায় উপরিউক্ত তথ্যপ্রাপ্তি সহজও নয়। পদোন্নতির ক্ষেত্রে এসব গুণাবলির কোনো ব্যবহারও নেই। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্যভাণ্ডারে উপরিউক্ত তথ্য না থাকায় পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংস্থার তথ্য বা প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করতে হয়। বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্ট নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে বড় ধরনের অসন্তোষ রয়েছে। তাদের দাবি, গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনেক সময় নিরপেক্ষ হয় না। প্রকৃত সত্য তাতে উঠে আসে না। তা ছাড়া গোয়েন্দা প্রতিবেদন কেন, পরীক্ষা নিয়ে পদোন্নতি দিলেই তো আর ঝামেলা থাকে না।
জিইএমএসে বলা হয়েছে, প্রয়োজনীয় তথ্য সংরক্ষণের সুযোগ না থাকায় দরকারের সময় উপযুক্ত অনুসন্ধান করা যায় না। ফলে অনেক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয় না। ঘটে বিপত্তি। ছাত্রজীবন ও কর্মজীবনে সরকারদল সমর্থিত হওয়া সত্ত্ব্বেও অনেকে পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন, হচ্ছেন। বাবা-দাদাসহ পরিবারের সবাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করলেও পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন এমন কর্মকর্তার সংখ্যাও কম নয়। এক সময় পদোন্নতিবঞ্চিতদের নিয়ে বেশ তোড়জোর হলেও এখন তা আর খুব একটা হয় না। কারণ এখন সবাই নিজেদের সরকারদলীয় সমর্থক দাবি করে এবং নিজেদের মধ্যে প্রাপ্তিবঞ্চনা নিয়ে আনন্দ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে।
জিইএমএসে বলা হয়েছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মানবসম্পদ ব্যাবপনা পদ্ধতি অনেক পুরোনো কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। প্রশাসন ক্যাডারের উপসচিব থেকে ও তদুর্ধ্ব কর্মকর্তাদের জন্য পিএমআইএস নামে একটি ডেটাবেইজ রয়েছে। এই ডেটাবেইজটি বহুকাল আগে তৈরি। এতে তথ্যের পরিমাণ খুবই কম। সুতরাং এই ডেটাবেইজ হালনাগাদ বা সর্বশেষ তথ্যসমৃদ্ধ উন্নত নয়। অপরদিকে এই ডেটাবেইজটি চাইলেই হালনাগাদ করা সম্ভব নয়। ক্ষেত্র বিশেষ জটিলতা আরো বেড়ে যাবে। সার্ভিক পরিস্থিতি বিচেনায় নিয়ে উল্লিখিত অব্যবস্থপনা নিরসনের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সরকারি কর্মচারী ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি-জিইএমএস নামে একটি কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
যা গত নভেম্বর থেকে নিয়ে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসের মধ্যে বাস্তবায়িত হবে। এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য হচ্ছে— জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মানবসম্পদ পদ্ধতির আধুনিকায়ন করা। সরকারি কর্মচারী ব্যবস্থাপনা গতিশীল করা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অধিকতর ন্যায্যতা নিশ্চিত করা। এই কর্মসূচির আওতায় যা করা হবে তা হলে সরকারি কর্মকর্তাদের এবং বিদ্যমান সরকারি পদসমূহের এবটি নির্ভরযোগ্য গতিশীল তথ্যভাণ্ডার তৈরি করা হবে। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় তথ্য-উপাত্তভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ তৈরি করা। যথাযথ ও কার্যকর কর্মকৃতি মূল্যায়ণের উপযুক্ত পদ্ধতি প্রণয়ন করা এবং মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, বিশ্লেষণের সুযোগ তৈরি করা হবে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের, সংস্থার পদ সৃজন, জনবল কাঠামো নির্ধারণকালে পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে পড়ে। এতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া জটিল হয়। কাজটি সম্পন্ন করতে সময় লেগে যায়। পদায়নের ক্ষেত্রেও শূন্য পদের তথ্যপ্রাপ্তিতেও নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়। ফলে শূন্যপদের তথ্য, প্রয়োজনীয় জনবলের তথ্য, সৃজিত পদের যথাযথ তথ্য প্রয়োজনমতো পাওয়া যায় না। কারিগরি পদসমূহে পদায়নের ক্ষেত্রে বিশেষ ধরনের ডিগ্রি, প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা দরকার হয়। সঠিক তথ্যের অভাবে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা থাকা সত্ত্ব্বেও যথাযথ ব্যক্তিকে যথাস্থানে পদায়ন করা যায় না। কর্মকর্তাদের আগ্রহের বিষয় এবং প্রত্যাশিত পদায়ন জানা না থাকায় বিভ্রান্তি হয়। একই সাথে দেশের সরকারি সেক্টরে সাংগঠনিক কাঠামো ও পদবিন্যাস, নিয়োগের শর্তাবলি এবং নিয়োগ পদ্ধতি বেশ পুরোনো। এই ক্ষেত্রে সংস্কার জরুরি।
বিষয়টি নিয়ে গবেষণা ও বিশ্লেষণ করা হলে বর্তমান সমস্যা চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা যাবে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কর্মকর্তারা বলছেন, সিভিল সার্ভিসের দক্ষতা উন্নয়ন এবং মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। যা পরিবর্তনশীল বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিকায়নের দাবি রাখে।
প্রযুক্তিনির্ভর, আধুনিক, তথ্যসমৃদ্ধ গতিশীল ডেটাবেইজ তৈরি এখন সময়ের দাবি। যা তৈরির কাজে হাত দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সরকারের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষ হচ্ছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সিভিল সার্ভিসের ক্যাডার গঠন, নিয়োগের শর্তাবলি নির্ধারণ, নিয়োগ, পদায়ন, প্রেষণ, পদোন্নতি, প্রশিক্ষণের আয়োজন করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর, সংস্থার সাংগঠনিক কাঠামো নির্ধারণ, নিয়োগের শর্তাবলি নির্ধারণ, নিয়োগ পদ্ধতি ও কৌশল-পদ্ধতিও নির্ধারণ করে এ মন্ত্রণালয়। প্রশাসন ক্যাডারসহ এসএসবির আওতায় পদোন্নতিপ্রাপ্তদের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা, এসিআর ব্যবস্থাপনা, গণকর্মচারীদের আচরণ, শৃঙ্খলা, বিভাগীয় মামলা, মূল্যায়ন ও পুরস্কারসহ সার্ভিক বিষয়গুলো মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার অংশ। এ কর্মসূচি বাস্তায়নে সরকারের ১১ কোটি টাকা ব্যয় হবে বলে জানা গেছে।