১৭ বছরে মানুষের হাতে হত্যার শিকার হয়েছে ১১৮টি হাতি
মামলা হলেও আসামি অজ্ঞাত, কারণ অনুসন্ধানে অন্ধকারে বন বিভাগ
চুনতি বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য বাংলাদেশের একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য। এটি চুনাতি অভয়ারণ্য নামেও পরিচিত। যার আয়তন ৭,৭৬৪ হেক্টর। বনের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও বিপন্ন বন্যপ্রানী সংরক্ষনের জন্য ১৯৮৬ সালে এই অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলাদেশ ও মায়ানমারের মধ্যে বন্য এশীয় হাতির যাতায়াতের একটি করিডোর হিসেবে এই অভয়ারণ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। এই বনের ব্যবস্থাপনা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্ততায় এখানে সহব্যবস্থাপনা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই অভয়ারণ্য তার বিশালাকায় শতবর্ষী মাদার গর্জন গাছের জন্য সুপরিচিত যা এই বনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তবে ক্রমাবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ, নির্বিচারে গাছ কাটা, কৃষি জমিতে রূপান্তরের মাধ্যমে বন্যপ্রানীর আবাসস্থান ধ্বংস প্রভৃতি কারণে এ বনের অস্তিত্ব আজ হুমকির সম্মুখীন।
চুনতি অভয়ারণ্য চট্টগ্রামের বাঁশখালী, লোহাগাড়া ও সাতকানিয়া উপজেলা এবং কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ৭৭৬৪ হেক্টর বা ৭৭ বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। চট্টগ্রাম বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগ বন বিভাগের চুনতি রেঞ্জ ও জলদি রেঞ্জ নিয়ে এ অভয়ারণ্য গড়ে তোলা হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় ২০০৩ সালে চুনতি ও জলদি রেঞ্জের অধীনে সাতটি বিট অফিস স্থাপন করা হয়।
এই অভয়ারণ্য মূলত টিলাময় এবং অনেক জায়গায় পাহাড়ি ভূপ্রকৃতি, প্রচুর অগভীর ও গভীর খাদ রয়েছে। কোথাও সামান্য ঢালু জায়গা আবার কোথাও খাড়া ঢাল দেখা যায়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর গড় উচ্চতা ৩০ থেকে ৯০ মিটার। বনের ভেতর দিয়ে প্রচুর খাঁড়ি বা পাহাড়ি ছড়া এঁকেবেকে বয়ে গেছে,এদের তলদেশ বালুময় বা পাথুরে। এই ছড়াগুলো বন্যপ্রানীদের পানির উৎস।
চুনতি অভয়ারণ্য এক সময় জীববৈচিত্রে সমৃদ্ধ স্থান। বন ধ্বংসের কারণে যা দিন দিন কমে আসছে। বন্য এশীয় হাতি এই বনের অন্যতম আকর্ষণ এবং এরা বাংলাদেশ ও মায়ানমারের মধ্যে বনের মধ্য দিয়েই চলাচল করে। এই বনে ১২০০ প্রজাতির উদ্ভিদ দেখা যায়। যার মধ্যে ৪৫ প্রজাতির উচু গাছও রয়েছে। বড় প্রজাতির গাছের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: গর্জন, রাকতান, জাম, উরি আম, চাপালিশ, শিমুল, কড়ই প্রভৃতি। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ভেষজ উদ্ভিদ এবং লতাগুল্ম এ বনে পাওয়া যায়।
পূর্বে এই বনে ১৭৮ প্রজাতির জীবজন্তু ও পাখি পাওয়া যেতো, যার মধ্যে রয়েছে ৬ প্রজাতির উভচর, ৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৩৭ প্রজাতির পাখি এবং ২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী। তবে এদের একটি বড় অংশ বর্তমানে আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে, বেশ কিছু প্রজাতি একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে বা বিলুপ্তির পথে। জীবজন্তুর মধ্যে ২ প্রজাতির উভচর, ২ প্রজাতির সরীসৃপ, ২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী এবং প্রায় ১১ ধরনের পাখি বর্তমানে বেশি দেখতে পাওয়া যায়। বন্য প্রানীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: হাতি, কয়েক ধরনের বিড়াল, দেশি বন শুকর, হনুমান প্রভৃতি এবং পাখির মধ্যে আছে: কাঠঠোকরা, ছোট বসন্তবৌরি, বনস্পতি, কানাকুয়া, আবাবিল, তিলা ঘুঘু, ফিঙে, বনময়না, ভাত শালিক প্রভৃতি। এছাড়াও বেশ কিছু জলজ প্রানীও এই বনে পাওয়া যায়।
সম্প্রতি আলোচনা সমালোচনার জন্ম দিয়েছে বন্যহাতি হত্যাকা- নিয়ে। প্রশ্ন আসছে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নিয়েও।
বাঁশখালীর চাম্বল অভয়ারণ্য বনবিট প্রভাবশালী বনদস্যুদের দখলে। যার ফলে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে হাতি ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। পাহাড়ে বাগানের গাছ কেটে বনবিভাগের জায়গা দখল, গভীর বনাঞ্চলে পাকা বাড়ি নির্মাণের ফলে হাতির চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে প্রতি নিয়ত। কিন্তু এসব দেখেও মুখ বুঝে নিরবে বসে আছে জলদী রেঞ্জ কর্মকতা বাঁশখালী বনবিটের কর্মকর্তা আনিসুজ্জামান শেখ। দিন দিন মানুষের সাথে হাতির দ্বন্দ্ব বেড়েই চলছে চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারন্যে। যার ফলে হাতি চলাচলের বাধা সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
সম্প্রতি চুনতি-বাঁশখালী, চকরিয়ায় অভয়ারণ্য হাতি হত্যার বেশ কিছু আলামত জব্দ, সুস্পষ্ট কারণ ধরাপড়লেও বনবিভাগ মামলার বিবরণে উল্লেখ করা হয় কারণ অজ্ঞাত, আসামী অজ্ঞাত। বনবিভাগের কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে স্থানীয়রা বার বার হাতি হত্যা করে ধরা ছোয়ার বাইরে রয়ে যায়।
বাঁশখালী চাম্বল অংশে বি.এস.৩ দাগের জায়গায় গড়ে উঠেছে মুরগির পল্ট্রি ফার্ম ও পাকা বাড়ি নির্মাণের ফলে হাতি চলার ব্যাঘাত সৃষ্টি করার জন্য কাঁটা তারের বেড়া দিয়েছে স্থানীয় এক চেয়ারম্যান মুজিবুল হক চৌধুরী। বি.এস. ১৫২ দাগে স্থানীয় চেয়ারম্যান ২০১৭ ও ২০১৮ সালে সরকারি বন বিভাগের জায়গায় বাগান দখল করে টিউবওয়েল ও অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে পাহাড় আলোকিত করার ফলে বন্যপ্রাণী প্রজনন ও বিচরণে ক্ষতি হচ্ছে।
২০১৭ ও ২০১৮ সালের বিভাগীয় কর্মকর্তা এস.এম. গোলাম বাগান পরিদর্শনে গিয়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখে দঃখ প্রকাশ করে বলেন, এখানে অনেক সরকারি বন বিভাগের জাগায় এতকিছু হয়েছে তা আমার জানা ছিল না। তারা কিভাবে রাতের অন্ধকারে পাহাড় কেটে সমতল করে এতসব কিছু করে রেখেছে। বি.এস. ৭৯ দাগ মুজিবুল হুসাইন টিপু হাতি চলাচলের জায়গায় বাগান কেটে লেবু গাছ, মালটা গাছ রোপন বাগানের নাম দিয়ে দখলে রেখেছে। এছাড়াও বি.এস. ৬৫৭ দাগে মুজিবুল হুসাইন টিপু সরকারী বাগান কেটে লেবু বাগান করে রেখেছে। এই বাগান চাষের কারণ জিজ্ঞাসা কলে মুজিবুল হুসাইন টিপু বন বিভাগের লোকদের হুমকি প্রদান।
এসব কিছু দেখেও নিরব ভূমিকা পালন করছে চাম্বল অভয়ারণ্য বন কর্মর্তা ও জলদি রেঞ্জ কর্মকর্তা আনিসুজ্জামন শেখ।
এছাড়াও বাঁশখালী, লোহাগাড়া ও সাতকানিয়া উপজেলা এবং কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বেশ কিছু স্থানের সরকারি বনভূমি স্থানীয় প্রভাবশালী চেয়ারম্যান, মেম্বার, রাজননৈতিক ব্যক্তি, সরকারি কর্মকর্তা যে যার মত করে প্রবাব খাঁটিয়ে দখল করে রেখেছে।
এই নিয়ে চট্টগ্রামের বেশ কিছু দৈনিক পত্রিকা, টিভি চ্যানেল, অনলাইন পত্রিকা প্রতিবেদন প্রকাশ করলেও দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বন বিভাগের কর্মকর্তারা অনিহা প্রকাশ করে। কারণ হিসেবে চিহ্নিত করলে দেখা যায় যে, দখলদারা বন কর্মকর্তাদের প্রাণ নাশের হুমকি, স্থানীয় ক্ষমাতার ব্যবহার এবং উর্ধ্বতন বন কর্মকর্তাদের যোগসাজস রয়েছে।
বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী সুরক্ষায় যে আইন করা হয়েছে তা বিশ্বের যেকোনো দেশের চাইতে অনেক কঠোর। কিন্তু এই আইনের যথেষ্ট প্রয়োগ নেই।
বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইন অনুযায়ী, কোন ব্যক্তি হাতি হত্যা করেছে বলে প্রমাণিত হলে তিনি জামিন পাবে না এবং অপরাধীকে সর্বনিম্ন দুই বছর এবং সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত কারাদ- এবং সর্বনিম্ন এক লাখ থেকে সর্বোচ্চ দশ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদ- দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
একই অপরাধ পুনরায় করলে সর্বোচ্চ ১২ বছর পর্যন্ত কারাদ- এবং সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদ- দেয়ার বিধান আছে।
এছাড়াও আইনে অভয়ারণ্যে, গাছ কাটা, গাছ সংগ্রহ, বন ধ্বংস এমনকি বনভূমির অংশে চাষাবাদ করাও নিষেধ করা হয়েছে। এরপরও দেখা গেছে বন বিভাগের জমি লিজ নিয়ে চলছে, ফল, সবজি ও ধানের আবাদ। গড়ে উঠছে বসতি।
বনভূমি দখলমুক্ত করা, ফাঁদ ও বিষটোপ দূর করা, সেইসঙ্গে বন্যপ্রাণী হত্যায় জড়িত অপরাধীদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা, এক কথায় বন্যপ্রাণীর দেখভাল বন বিভাগের দায়িত্ব।
কিন্তু স্থানীয় এলাকাবাসী এবং রাজনীতিকদের চাপ, সেইসঙ্গে জনবল সংকট থাকায় মাঠ পর্যায়ের বন কর্মকর্তারা অনেকটাই কোণঠাসা।
এছাড়া মাঠ পর্যায়ে যে বন কর্মকর্তারা কাজ করেন তাদের যথাযথ জ্ঞান ও আন্তরিকতার অভাব রয়েছে-এমন অভিযোগও স্থানীয়দের।
হাতির পাল দিনের বেলা উঁচু ভূমিতে থাকে এবং সন্ধ্যার পর সমতলের দিকে নেমে এসে চুপিসারে বিচরণ করে। তারপর আবার পাহাড়ে উঠে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষ এই হাতিদের উত্তেজিত করে তোলে বলে অভিযোগ করে স্থানীয়রা।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ সাল থেকে গত ১৭ বছরে মানুষের হাতে হত্যার শিকার হয়েছে ১১৮টি হাতি।
আবার অনেক স্থানীয় সূত্রে জানায়, গ্রামের লোকজন বনে শুকর শিকার করতে গেলে বণ্যহাতির পাল সামনে চলে আসে। তখন তারা হাতির পালের দিকে গুলি ছুড়ে পালিয়ে যায়। এরমধ্যে হাতির মাথায় গুলি খেয়ে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায়।
অনেকে হাতি ঠেকাতে ক্ষেতের চারপাশে বিদ্যুতের জিআই তারের বেড়া দিয়ে সবজি ও ধান চাষ করছে। ফলে বৈদ্যুতিক ফাঁদে হাতিগুলো মারা যাচ্ছে। বন বিভাগের পক্ষ থেকে জিআই তারের বেড়া তুলে নেওয়ার জন্য বারবার বলা হলেও তারা তা শুনছে না।