এম. আলী হোসেন
২০১২ সাল ৪ঠা নভেম্বর ভোরে ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণে হাটাহাটি করছিলাম। এই সময় মোবাইল বাজল। ফোনে প্রিয় সায়েম সাহেব বললেন বাবু ভাইয়ের সে -ই খবর। শরীরের প্রাণটা কেমন করে কেপে উঠল । বুকটা কাপল। তখনো সূর্য উঠেনি। গোটা দুনিয়াটা অন্ধকার মনে হলো । কয়েকজন আওয়ামী নেতাকে ফোন করলাম । কিন্তু ফোন বন্ধ ও কারটা রিসিভ হয়নি। ওই সময় প্রায়ই আমার সাথে হাটত বন্ধু মুসা । সেই জানাল এই দুঃসংবাদটি। সেইদিনটি প্রতি বছর আসে।
১৯৯১ সালে বিএনপি ছিলেন ক্ষমতায় আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ছিলেন এমপি। ‘৯১ দেশে ২৯ এপ্রিলে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হলো।অপূরণীয় ক্ষতি হলো উপকুলীয় অঞ্চলে।বাবুর নির্বাচনী অঞ্চল আনোয়ারা ছিল উপকুলীয় অঞ্চল।লণডভণ্ড হয়ে যায় এই এলাকা । বিএনপি সরকার তাকেঁ কুতুবদিয়া অঞ্চলে দায়িত্ব দেয়। সেই সময় তিনি আনোয়ারা ফেলে কুতুবদিয়া যাননি বরং নিজ অর্থ ও জনবল দিয়ে উপকুলীয় মানুষের পাশে দাঁড়ালেন।ত্রাণ দিলেন, লাশ দাফন করলেন, প্রতি ঘরে ঘরে নগদ টাকা দিলেন।শেখ হাসিনাকে নিয়ে আসলেন উপকুলীয় অঞ্চলে ।গোদার পাড়া ব্রীজের পর এই জনপদের রাস্তাঘাটের অভাবে আর যেতে পারলেন না দক্ষিণে ।সেই থেকে বাবু মিয়া উপকুলের মানুষের প্রিয়জন হলেন। এখনো উপকুলীয় অঞ্চলের মানুষ বাবুকে ভালবাসেন শ্রদ্ধায় ও বিবেকে।
চট্টগ্রামের এক বটবৃক্ষ ছিলেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু । গোটা দেশে ও দলে তারঁ ছিল আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। দলের মধ্যে নানা টানাপড়েনের মধ্যেও দলীয় আদর্শে অবিচল থাকা চট্টগ্রামের বর্ষীয়ান রাজনীতিক আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু নানা কর্মকাণ্ডে কাটিয়েছেন ৭২ বছরের বর্ণাঢ্য জীবন ।
মুক্তিযুদ্ধের এ সংগঠক কেবল রাজনীতিতে নয় ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্পোন্নয়নের মাধ্যমে দেশের মাটি ও মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন আজীবন। কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব দূরীকরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি।
চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় এ রাজনীতিবিদ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন।দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যও নির্বাচিত হন তিনি। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনোয়ারা থেকে নির্বাচিত এ সাংসদ পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।
চট্টগ্রামের আওয়ামী রাজনীতির এ খ্যাতিমান পৃষ্ঠপোষক আনোয়ারা উপজেলার হাইলধর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা নুরুজ্জামান জমিদার হলেও পেশায় ছিলেন আইনজীবী।
১৯৫৮ সালে আখতারুজ্জামান চৌধুরী পটিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ওই বছরই ঢাকার নটরডেম কলেজে ভর্তি হন। উচ্চমাধ্যমিকে পড়াশোনরা সময়ে শিক্ষা বৃত্তি নিয়ে তিনি আমেরিকার ইলিয়ন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে ভর্তি হন। পরে তিনি নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে পড়াশোনা করেন। সেখান থেকে অ্যাসোসিয়েট ডিগ্রি নিয়ে ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে দেশে আসেন। এরপর ১৯৬৫ সালে বড় ভাইয়ের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেন।
চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ১৯৬৭ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে সত্তর’র সাধারণ নির্বাচনে আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়া থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তাঁর পাথরঘাটা জুপিটার হাউস থেকে সংগ্রাম কমিটির কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামে আসার পর ওই হাউস থেকেই সাইক্লোস্টাইল করে প্রচার করা হয়। তার বাসা থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ সব জায়গায় পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ভারতে গিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি বিশ্বজনমত গড়তে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে যান।
স্বাধীনতার পর আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এ পদে বহাল ছিলেন। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। পঁচাত্তর সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দল পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখায় কারাভোগসহ নির্যাতনের শিকার হন তিনি।
রাজনীতির পাশাপাশি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে দেশের বেকারত্ব দূর করার ক্ষেত্রেও অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন এ শিল্পোদ্যোক্তা। স্বাধীনতার পূর্বে নগরীর বাটালি রোডে রয়েল ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠা করেন। পরে আসিফ স্টিল মিল, জাভেদ স্টিল মিল, আসিফ সিনথেটিক, প্যান আম বনস্পতি, আফরোজা অয়েল মিল, বেঙ্গল সিনথেটিক প্রোডাক্টসহ কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এ ছাড়া জামান শিল্প গোষ্ঠী ও বিদেশি মালিকানাধীন আরামিট মিল ক্রয় করেন এবং পরবর্তীকালে আরামিট গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন।
এসবের পাশাপাশি তিনি বেসরকারি সেক্টরে দেশের দ্বিতীয় প্রাইভেট ব্যাংক ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডের (ইউসিবিএল) উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন।
আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু দেশের ব্যবসায়ী সমাজের মুখপাত্র হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। দুই দফা চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি এ ব্যবসায়ী নেতা দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সভাপতি ছিলেন। দায়িত্ব পালন করেছেন ওআইসিভুক্ত দেশের চেম্বার সভাপতি হিসেবে। ১৯৮৯ সালে তিনি ৭৭ জাতি গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
দেশের অন্যতম জনপ্রিয় এ নেতা আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়ায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।তার বড় ছেলে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এখন আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়া আসনের এম পি এবং বর্তমান সরকারের ভুমি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ইতিপূর্বে এই মহান সংগঠক মরণত্তোর স্বাধীনতা পদক পান এবং ভুমিমন্ত্রী পান বিরল সম্মাণের জাতীসংঘ পদক।