আল-হেলাল,সুনামগঞ্জ
সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার হিন্দু অধ্যুষিত নোয়াগাঁও গ্রামে হেফাজত নেতা মামুনুল হকের অনুসারী হামলাকারীরা প্রায় ৮৮টি বাড়িঘর এবং ৮টি পারিবারিক মন্দিরে ভাঙচুর ও লুটতরাজ
করেছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ কোটি টাকা। হামলায় অংশ নিয়েছিল প্রায় আড়াই হাজার মানুষ। হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হককে নিয়েএক ব্যক্তির ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার জের ধরে তাঁর কয়েক শ অনুসারী ১৭ মার্চ বুধবার সকালে ওই গ্রামে হামলা চালানো হয়। এ সময় হামলাকারীরা প্রায় ৮৮টি বাড়িঘর এবং সাত-আটটি পারিবারিক মন্দিরে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়।
শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া ঝুমন দাস আপনের ঘরের বিছানা ছিল এলোমেলো। মেঝেতে পড়ে আছে রান্নার সরঞ্জাম। ঘরে কেউ নেই। পাশের ঘরের লোকজন জানায়, হামলার সময় দৌড়ে পালাতে গিয়ে আহত হয়েছেন ঝুমন দাসের স্ত্রী। তিনি চিকিৎসা নিতে উপজেলা সদরে গেছেন। প্রশাসন যতই শান্তি ও সাহসের বাণী ছড়াকনা কেন গ্রামের প্রায় ২ শতাধিক নারীপুরুষ ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পার্শ্ববর্তী এলাকাতে আশ্রয় নেয় ঘটনার দিন। বর্তমানে ৫০/৬০ জন পুরুষ ফিরে এলেও বাকীরা বাড়ীতে ফিরেনি। এখনও তারা আতঙ্কিত রয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন শাল্লা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামীলীগ নেতা এডভোকেট অবনী মোহন দাস এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শনকারী জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট নজরুল
ইসলাম শেফু।
ঝুমন দাসের পাশে রবীন্দ্র দাসের ঘরসহ কয়েকটি কাঁচা ঘরেও হামলার চিহ্ন দেখা গেছে। ঘরের ভেতরে চেয়ার, স্টিলের আলমারি, শোকেসসহ বিভিন্নআসবাবপত্র ভাঙা। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিবেকানন্দ দাস বকুলের ঘরও ভাঙচুর করা হয়। খবর পেয়ে শাল্লা ও দিরাই থানা পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। কিন্তু ওসি ইউএনও ও উপজেলা চেয়ারম্যানকে দফায় দফায় জানানো হলেও পরিকল্পিত হামলা ও লুটতরাজে কোন পূর্ব প্রস্তুতি নেয়া হয়নি।
গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাইকে ঘোষণা দিয়ে ব্যাপকভাবে প্রচারাভিযান চালিয়ে লাঠিসোঁটা, দা, রামদা, কিরিচসহ নানা ধরনের দেশীয় অস্ত্র নিয়ে দাড়াইন নদী পার হয়ে নোয়াগাঁও গ্রামে মিছিল নিয়ে
আসতে থাকে হামলাকারীরা। বিষয়টি প্রত্যক্ষ করে গ্রামের নারী-পুরুষ ঘরবাড়ি ফেলে বাইরে পালিয়ে যায়। অনেকে ঘর তালাবদ্ধ করে ভেতরে বসে থাকে। নাচনি গ্রামের স্বাধীন মেম্বার ও ফক্কনের নেতৃত্বে কয়েক শ মানুষ গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্র দাস, কাজল চন্দ্র দাস, সুনু রঞ্জন দাস, অনিল কান্তি দাসসহ গ্রামের সাতজন মুক্তিযোদ্ধার বাড়িঘরে হামলা করে।
মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্রের পাকা ঘরের দরজা-জানালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে সব কিছু তছনছ করে দেয়। এরপর গ্রামের একে একে ৮৮টি ঘরে হামলা ও লুটপাট চালায় তারা। প্রতিটি ঘর
থেকেই নগদ টাকা, সোনাদানাসহ মূল্যবান জিনিস লুটতরাজ করে হামলাকারীরা। গ্রামবাসী জানান, হামলায় অংশ নেয় নাচনি গ্রামের স্বাধীন মিয়া, ইমারত আলী, ইনাত আলী, মির্জা হোসেন, নেহার আলী, আলম উদ্দিন, আনোয়ার হোসেন, আলকাছ, হুমায়ুন, লুৎ্ধসঢ়;ফুর, মো. ফারুক, আকামত, কেরামত, কাশিপুর গ্রামের নবাব মিয়া, সাইফুল, আব্দুল মজিদ, তৌহিদসহ ৭ শতাধিক লোক।
শৈলেন দাস বলেন, ‘ঝুমন দাসকে আমরা নিজেরাই ধরে পুলিশে দিয়েছি। আইনের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। আমার আলমারি ভেঙে সোনাদানা, টাকা-পয়সা লুট করে নিয়ে গেছে। ঘরের সব কাপড়-চোপড়ও নিয়ে গেছে।’
বৃহস্পতিবার বেলা ১টার দিকে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন ও পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এ সময় পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, অপরাধীদের কোনো পরিচয় নেই, তারা শুধুই অপরাধী। ঝুমন দাসের বিরুদ্ধে যেভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তেমনি হামলার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গ্রামে পুলিশ
মোতায়েন থাকবে।
জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। প্রশাসন আপনাদের পাশে রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ পারিবারিক পূজার স্থান মেরামত ও পরিবারকে জিআরের চাল ও নগদ অর্থ সহায়তার আশ্বাস দেন তিনি।
জানা যায়, গত ১৫ মার্চ সোমবার দিরাইয়ে হেফাজতের এক সমাবেশে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব আল্লামা মামুনুল হক। ওই দিন রাতে নোয়াগাঁও গ্রামের ঝুমন দাস আপন তাঁর
ফেসবুকে মামুনুল হককে কটাক্ষ করে স্ট্যাটাস দেন। বিষয়টি স্থানীয়দের নজরে এলে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে লোকজন। পরদিন মঙ্গলবার সন্ধ্যায় স্থানীয় দাড়াইন বাজারে বিক্ষোভ সমাবেশ করে তারা। রাতেই উপজেলার শাসকাই গ্রাম থেকে ঝুমনকে আটক করে শাল্লা থানা পুলিশ। ঝুমনকে আটকের পর রাতভর পাশের গ্রাম দিরাই উপজেলার চন্ডিপুর, ধনপুর, শ্যামারচরসহ, শাল্লা উপজেলার কাশীপুর, আনন্দপুর,
সুলতানপুর গ্রামে দফায় দফায় বৈঠক করে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসীকে শান্ত করার চেষ্টা করেন শাল্লা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ আল আমিন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার আল মুক্তাদিরসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গরা। হেফাজতে ইসলামের দিরাই উপজেলা সহসভাপতি মাওলানা নূর উদ্দিন বলেন, ‘কারা হামলায় জড়িত আমরা জানি না।” অভিযোগের ব্যাপারে
জানতে চেয়ে স্বাধীন মেম্বারের মুঠোফোনে কল করলে তার সংযোগটি বন্ধ পাওয়া যায়। সর্বশেষ খবরে জানা যায় এ ঘটনায় শাল্লা থানায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং পুলিশ এ পর্যন্ত দিরাই উপজেলার নাচনী গ্রামের ১৬ জন ও শাল্লা থানার ৬ জনকে আটক করেছে।